সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার নারীদের অসহায়ত্ব
২৯ নভেম্বর ২০১৯সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা সুমি আক্তার এবং হোসনা আক্তারকে নিয়ে এখন বাংলাদেশে চলছে তুমুল আলোচনা৷ তাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন৷ দূতাবাস তাঁদের উদ্ধার করে দেশে পাঠিয়েছে৷ কিন্তু তাঁদের কেউই ক্ষতিপুরণের টাকা নিয়ে আসতে পারেননি৷ তাঁদের যে নির্যাতন করা হয়েছে সে বিষয়ে ওই দেশে মামলাও করেননি৷
মামলা না করার কারণ জানতে চাইলে সুমি কিছু বলতে রাজি হননি৷ তবে ফিরে আসা আরেক নারী বলেন, ‘‘সেখানে রাস্তায় বের হলেই তো পুলিশ ধরে আটক করে৷ মামলা করব কিভাবে? তাছাড়া দূতাবাসও সহায়তা করে না৷ মামলা করতে গেলে বিপদ আরো বাড়ে৷ চুক্তিতে থাকা ক্ষতিপুরণের টাকাই পাওয়া যায় না, আবার মামলা!''
বুধবারও ৩৫ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন৷ সরকারি তথ্য বলছে, গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ নারী শ্রমিক সৌদি আরবে গেছেন৷ তাদের মধ্যে ১৩ হাজার দেশে ফিরে এসেছেন৷ ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছরের নয় মাসে সৌদি আরব থেকে ৪৮ নারীর মরদেহ বাংলাদেশে এসেছে৷ আর গত চার বছরে সৌদি থেকে ১৫২ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে৷ তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৩১ জন নারী৷ বাকীদের মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট নয়৷
আইন কোথায়?
প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি নারী কাজ করেন তাঁদের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই৷ একটিই আইন আছে বাংলাদেশে৷ ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক আইন৷ কিন্তু এই আইনে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্টদের ধরা যায়, সৌদি আরবে নির্যাতনের কোনো প্রতিকার করা যায় না৷ আইন অনুযায়ী, কেউ যদি প্রতারণার শিকার হন, শর্তভঙ্গ হয়, নির্যাততিত হন, তাহলে দাযিত্ব হলো রিক্রুটিং এজেন্সির৷ এখানে সাজা ও ক্ষতিপুরণের বিধান আছে৷ তবে এই আইনের বিধিগুলো অস্পষ্ট৷ যদি কেউ নির্যাতনের বা প্রতারণার অভিযোগ করে, তাহলে নিস্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগে৷ আরেকটি আইন আছে ২০১৭ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন৷ সেটাও এখানকার জন্য৷
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘‘সৌদি আরবে যে নারীরা যান, তাঁরা গৃহকর্মী হিসেবে বাসাবাড়িতে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রটিই সমস্যার, কারণ, সেখানে যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তা গৃহকর্তার দ্বারাই হন৷ সৌদি আইনে গৃহকর্তাকে বিশেষ অধিকার দেয়া আছে৷ সেখানে বিদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের প্রটেকশনের কোনো আইন নেই৷''
তিনি জানান, ‘‘জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই৷ পাঠানো হয় সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে৷ স্মারকেও দুর্বলতা আছে৷ যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও এটা আরেকটু শক্ত করা যেতো যে ওখানে গিয়ে কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে যেন ওখানকার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেটাও করা হয়নি৷ আর নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো নারী যখন এমন অবস্থায় উপনীত হয়, ওই দেশ ছেড়ে আসতে পারলেই সে তখন বেঁচে যান৷ আর ওখানে সে থাকবেই বা কিভাবে৷ থেকে যদি মামলা করেও, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা কোথায়?''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের যে আইন আছে তাতে বিএমইটি হয়তো ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে পারে, কিন্তু নির্যাতনের বিচার তো করতে পারে না৷''
অভিযোগ সেল
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-তে একটি অভিযোগ সেল আছে৷ প্রবাসী কর্মীরা নির্যাতন বা প্রতারনার শিকার হলে সেখানে অভিযোগ করতে পারেন৷ এটাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করার সরকারি সেল৷ ওই সেলের হিসাব অনুযায়ী, এই বছরের অক্টোবর মাসে সেখানে অভিযোগ পড়েছে ৪২৭টি৷ এসব অভিযোগের মধ্যে ২৬১টি অনলাইনে এবং ১৬৬টি সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে করা হয়েছে৷ আর নিস্পত্তি হয়েছে ৩২৫টি৷ ৭৬ ভাগ অভিযোগ নিস্পত্তির কথা বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে৷ এখন প্রশ্ন হলো, অভিযোগগুলো কিভাবে নিস্পত্তি করা হয়েছে? সেটা খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ অভিযোগই পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে সমঝোতার মাধ্যমে৷
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার রোকসানা মোহাম্মদ আতিয়া বলেন, ‘‘আইনে প্রতারণার মামলা করা যায়৷ কিন্তু আমরা চেষ্টা করি সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে৷ আমরা আমাদের কাছে আসা কেসগুলো বিএমইটি'র আরবিট্রেশন সেলে পাঠাই৷ সেখানে একটা সমঝোতা হয়ে যায়৷ কিন্তু সমঝোতা না হলে প্রতিকারের জন্য আমরা এখন পর্যন্ত কোনো আইনি পদক্ষেপে যাইনি৷ আর আমার জানা মতে কেউ ব্যক্তিউদ্যোগে মামলা করেননি৷ তবে যদি সেটা পাচারের ঘটনা হয়ে যায়, তাহলে মামলা হয়৷ কিন্তু তাতে তেমন প্রতিকার পাওয়া যায় না৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিদেশে কর্মজীবী নারীরা নিয়োগকর্তার নির্যাতনের শিকার হন৷ কিন্তু সেখানে নির্যাতনের শিকার নারীর মামলা করার সুযোগ নেই বললেই চলে৷ কারণ, মামলা করতে হবে ব্যক্তিগতভাবে৷ সেখানে তাকে থাকতে হবে আর এরজন্য দূতাবাসের সহায়তা দরকার৷ তাই এমওইউতে ক্ষতিপূরণের বিধান আছে৷ সেটাই তারা পাওয়ার চেষ্টা করেন৷''
এই পরিস্থিতি কেন?
বিশ্বের ২৯টি দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে লেবার এটাশে আছে৷ এটা সৌদি আরবেও আছে৷ সেখানে সেফ হোমও আছে৷ তারপরও পরিস্থিতি এত খারাপ কেন? এ প্রসঙ্গে বিএমইটি'র পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান বলেন, ‘‘যাঁরা নির্যাতনের বা প্রতারণার শিকার হয়, তাঁরা ওইসব দেশে ফৌজদারি মামলা করতে চায় না, কারণ, ফৌজদারি মামলা করলে মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয়৷ এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না৷ আমাদের দূতাবাসগুলো তাঁদের রাখার ব্যবস্থাও করতে পারে না৷ তাছাড়া তাঁদের আকামার সময়ও শেষ হয়ে যায়৷ তাঁরা ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করে৷ এটা দ্রুত সম্ভব, যদি প্রমাণ করা যায়৷ আর আমরা ২০১৩ সনের আইনে যেটুকু কাভার করে, সেটুকুই করি৷ আমরা রিক্রুটিং এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের দেশের কোনো শ্রমিক নির্যাতনে মৃত্যুর পর সেখানে কোনো মামলা হয়েছে এমন কোনো নজির এ পর্যন্ত নেই৷ যদি হত্যার ঘটনা প্রমাণ করা যায়, তাহলে ওই দেশের আইনে মামলা হয়৷ কিন্তু প্রমাণ করা যায় না৷''
আইন অনুযায়ী বাংলাদেশি কোনো প্রবাসী কর্মীর মৃতদেহ এলে বিএমইটি তাৎক্ষণিকভাবে বিমানবন্দরে ৩৫ হাজার টাকা দেয়৷ পরে আরো সাড়ে তিন লাখ টাকা দেয়া হয় তাঁদের উত্তরাধিকারীদের৷ কিন্তু নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে এলে এ ধরনের কোনো সহায়তাও নেই৷
আর আইওএম-র একজন কর্মকর্তা জানান যে, আইন আছে, তার কোনো সমন্বয় নেই৷ আইনটির সঙ্গে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, সিভিল এভিয়েশন, প্রবাসী কল্যাণ ও শ্রম মন্ত্রনালয় জড়িত৷ আর আন্তর্জাতিক যে অভিবাসন আইন আছে তা কোনো দেশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়৷ তাই সেই সুবিধাও পান না সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরা৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷