ক্রাইস্টচার্চে হামলাকারী ‘লোন উল্ফ'?
৯ এপ্রিল ২০১৯নরওয়ের সন্ত্রাসী আন্ডার্স ব্রাইভিককে, যে ২০১১ সালের ২২ জুলাই ৭৭ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, প্রায়ই ‘লোন উল্ফ' বা ‘একক হামলাকারী' হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ ‘‘ইউরোপ ক্রমশ সন্ত্রাসীদের হামলার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, তবে, ব্রাইভিকের কর্মকাণ্ড তাকে মহাদেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী লোন উল্ফ হামলাকারীতে পরিণত করেছে,'' ২০১৬ সালের এপ্রিলে নরওয়ের সাংবাদিক আসনে সিয়ারস্টাড নিউজউইক পত্রিকায় লিখেছেন৷
ক্রাইস্টচার্চের সন্দেহভাজন অপরাধী, যাকে কিনা মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর কয়েকঘণ্টার মধ্যেই লোন উল্ফ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, সে ব্রাইভিকের কঠোর অনুসারী ছিল৷
‘কোনো গ্রুপ হামলার নির্দেশ দেয়নি'
যেহেতু তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তাই এটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে সম্ভাব্য অপরাধী ব্রেন্টন টেরান্ট একাই হামলা সংক্রান্ত ৭৪ পৃষ্ঠার ইশতাহার লিখেছিল৷ সে মসজিদে হামলা চালানোর অল্প কিছু সময় আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইশতাহারটি প্রকাশ করেছিল, এমনকি দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্দার্নের কার্যালয়েও সেটির একটি কপি পাঠিয়েছিল৷ এতে লেখা আছে: ‘‘আমি কোনো সংগঠন বা গ্রুপের সরাসরি সদস্য নই যদিও আমি অনেক জাতীয়তাবাদী গ্রুপে অর্থ দান করেছি এবং অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি৷ তবে, কোনো গ্রুপ আমাকে হামলার নির্দেশ দেয়নি৷ আমি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷''
অবশ্য একইসঙ্গে ইশতাহারের লেখক উল্লেখ করেছে: ‘‘এসব সংগঠনের সদস্য সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন, আর এমন গ্রুপের সংখ্যা কয়েক হাজার৷''
যদিও টেরান্ট নিজেকে একক হামলাকারী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, সে একইসঙ্গে নিজেকে এক বড় মুভমেন্টের অংশও মনে করছে৷ সেক্ষেত্রে তাকে একক হামলাকারী হিসেবে কেন বিবেচনা করা হবে?
মতাদর্শগত পটভূমি
‘‘সন্ত্রাসীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে হামলা চালানোর ধারনাটি আমাদেরকে তাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মতাদর্শগত পটভূমির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ দেয়,'' ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক জেসন বুর্কে৷
বুর্কে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট' (আইএস) এবং আল-কায়দা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন৷ তিনি বিশ্বাস করেন লোন উল্ফ তত্ত্বের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির সহিংস হামলার দায় শুধুমাত্র তার উপরে চাপানো হয়৷
আধুনিক সন্ত্রাসীরা হয়ত সবসময় আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট কিংবা ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড' (এনএসইউ), একটি উগ্রডানপন্থি জার্মান সন্ত্রাসী সেল, যেটি কিনা কয়েকটি ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, এমন কোনো গ্রুপের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে না৷ তবে, তাদের মধ্যে উগ্রবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে তারা যে সামাজিক পরিবেশে বসবাস করে সেখানে৷ আর ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সন্ত্রাসীদের আন্তর্জাতিকভাবে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে এবং নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের সীমাহীন সুযোগ করে দিয়েছে৷ এমনকি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ফেসবুকে লাইভস্ট্রিমেরও সুযোগ পাচ্ছে তারা, যা টেরান্ট ক্রাইস্টচার্চে হামলার সময় করেছে৷
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ এক বিষয়ে একমত: সন্ত্রাসীরা নিজেদের সময়কারই পণ্য৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বাড়ছে, যা এক বৈশ্বিক সামাজিক ধারায় রূপ নিয়েছে৷ পপুলিস্ট ধারার রাজনীতি এই অসহিষ্ণুতায় ইন্ধন যোগাচ্ছে৷ উগ্রবাদের শিকড় আসলে সমাজের মূলধারাতেই নিহিত, যা মানুষের জীবনে ডিজিটাল ছোঁয়া লাগায় আবারো স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷
সন্ত্রাসবাদের সামাজিক উপাদান
প্রকৃত সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে৷ তবে অনলাইন যোগাযোগের বাস্তব পরিণতি রয়েছে৷ ডেভিড সানবলি, যে কিনা ২০১৬ সালের ২২ জুলাই মিউনিখে শপিং মলে হামলা চালিয়ে নয় ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, অনলাইনে জেনোফোবিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল৷ সানবলি হামলা চালানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রাইভিকের সন্ত্রাসী হামলার পঞ্চম বার্ষিকীর দিনটিকে বেছে নিয়েছিল৷ আর সেই দিন বেছে নেয়ায় তার মতো একই মতাদর্শের অনেকে তার প্রশংসাও করেছে৷
ইউরোপে হামলাকারী কিছু জিহাদি যারা আইএস এর প্রচারণা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এককভাবে হামলা চালিয়েছে বলা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আসলে সিরিয়া এবং ইরাকে থাকা আইএস সদস্যদের অনলাইনে যোগাযোগ ছিল৷ হামলা চালানোর কিছু সময় আগেও তারা তাদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করেছে৷ তাদের একজন হচ্ছে আনিস আমরি, যে কিনা বার্লিনে বড়দিনের মার্কেটে ট্রাক ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে৷
বুর্কে লিখেছেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদ কেউ নিজে নিজে করে না, এটি একটি সামাজিক ব্যাপার৷ মানুষ বিভিন্ন ধারণা, মতাদর্শ এবং কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, কেননা অন্যদেরও তাতে আগ্রহ আছে৷'' অনেক সময় অপরাধীরা বিখ্যাত হতে চায় এবং তার মতো একই কাজ করতে অন্যদের উৎসাহ যোগায়৷
ক্রাইস্টচার্চ হামলাকারী টেরান্ট যদি একাই ৭৪ পাতার ইশতাহার লিখেছে প্রমাণ হয়, তাহলে সে সুস্পষ্টভাবে নিজেকে ব্রাইভিক, ডিলান রুফের, এক শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসিস্ট যে কিনা ২০১৫ সালের ১৭ জুন সাউথ ক্যারোলিনায় গির্জাগামী নয় কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করেছিল, সঙ্গে একই কাতারে ফেলতে চেয়েছে৷ ইশতাহারে লেখা হয়েছে: ‘‘আমি ডিলান রুফ এবং আরো অনেকের লেখাগুলো পড়েছি, কিন্তু সত্যিকারের উৎসাহ পেয়েছি নাইট জাস্টিসিয়ার ব্রাইভিকের কাছ থেকে৷''
ব্রাইভিক আদালতের মধ্যে হিটলারের নাৎসি সেলুট দিয়েছিল, টেরান্ট হাতের বুড়ো আঙ্গুলি এবং তর্জনি ব্যবহার করে ইংরেজি ‘ওকে' সাইন দেখিয়েছে, যা উগ্রডানপন্থিরা নিজেদের মধ্যকার প্রতীক হিসেবে এখন ব্যবহার করছে৷
এটা অনেকেই জানেন যে ব্রাইভিক এবং টেরান্ট দেশে বিদেশে অনেক ডানপন্থি উগ্রবাদীদের সঙ্গে বাস্তব জীবনে এবং অনলাইন যোগাযোগ করেছিল৷ বিশেষ করে টেরান্ট হামলা চালানোর আগে ইউরোপসহ নানা অঞ্চলে অনেকে ঘোরাঘুরি করেছে৷ সে তার ফেসবুক পাতায়, যেটি ইতোমধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে, উগ্রপন্থিদের অনেক কন্টেন্ট শেয়ার করেছে৷ এমনকি ইউরোপের ডানপন্থি উগ্রবাদীদের নিয়ে বিভিন্ন সংবাদও শেয়ার করেছে, যার মধ্যে ডয়চে ভেলের একটি প্রতিবেদনও রয়েছে, যেটি ছিল জার্মানির সামরিক বাহিনীতে থাকা ডানপন্থি উগ্রবাদী সৈনিকদের বিষয়ে৷
ব্রাইভিক এবং টেরান্ট নিজেদের মনে করে আধুনিক সময়ের ধর্মযোদ্ধা, যারা তথাকথিত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় জাতির বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে চায়৷ তারা মুসলমানদের বিশেষভাবে ‘আক্রমণকারী' মনে করে, কেননা তারা তাদের মতে বিশ্বে কর্তৃত্ব স্থাপনের সংগ্রাম করছে৷
সবকিছু বিবেচনা করলে তাই এসব আক্রমণকারীকে একক হামলাকারী বিবেচনা করা যায় না৷ সন্ত্রাসীরা সমাজেরই অংশ - ফলে তাদের থামানোর দায়িত্বটাও সামগ্রিকভাবে সমাজের উপরই বর্তায়৷
সান্দ্রা পেটারসমান/এআই