খালেদার বিরুদ্ধে মামলার রায় কী হবে?
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮সারাদেশে চলছে ব্যাপক পুলিশি তল্লাশি এবং গ্রেপ্তার অভিযান৷ ঢাকার সব প্রবেশমুখে বসানো হয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট৷ মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে ঢাকায় এলাকাভিত্তিক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ৷ যানবাহনেও চালানো হচ্ছে তল্লাশি৷ বিশেষ করে ঢাকার লঞ্চ, বাস ও রেল স্টেশনে পুলিশ নজর রাখছে৷ সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রায়ের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রাজধানীতে নাশকতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কায় সভা, সমাবেশ, মিছিল ও জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে৷ ওই সময়ে নগরীতে যে কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র, এমনকি লাঠি বহনও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে৷
ডিএমপি'র উপ পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রায় ঘোষণার দিন আমরা রাস্তা বন্ধ করে কোনো সভা-সমাবেশ বা মিছিল এবং কোনো যানবাহনে বসে কোনো মিছিল বা বক্তৃতা করতে দেবো না৷ নগরবাসীর নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ কমিশনার তাঁর ক্ষমতাবলে এ আদেশ দিয়েছেন৷ যারা এ আদেশ অমান্য করবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে৷''
এদিকে সারাদেশের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন পুলিশের আইজি৷ মঙ্গলবার তিনি ওই ভিডিও কনফারেন্সে সারাদেশে পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলেছেন৷
এদিকে বুধবার (আজ) থেকে রায়ের দিনও পরিস্থিতি বুঝে মাঠে অবস্থান করতে বলা হয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের৷ তাঁদের বলা হয়েছে, মাঠ যেন আওয়ামী লীগের দখলে থাকে৷ ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডসহ সারাদেশে প্রতিটি ইউনিটে দলের পক্ষ থেকে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে৷ তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এতিমদের টাকা আত্মসাতের যে মামলার রায় হবে, তা আমরা করিনি৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ওই মামলা হয়েছে৷ ১১ বছর পর এই মামলার রায় হবে৷ আদালত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেবেন৷ তিনি দোষী হতে পারেন৷ আবার নির্দোষও হতে পারেন৷ যদি তাঁর শাস্তি হয়, তাহলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পরবেন৷ এটাই আইনি প্রক্রিয়া৷ কিন্তু কয়েকদিন আগে তারা পুলিশের ওপর হামলা করেছে৷ অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে৷ এই নাশকতা মেনে নেয়া যায় না৷ তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রায়ের দিন নাশকতার আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থানে আছে৷ রায়ের দিন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা কঠোর হস্তে দমন করবে৷''
অন্যদিকে গ্রেপ্তার তল্লাশির মুখেও বিএনপি এখনো শক্ত প্রতিবাদের জন্য প্রস্তুত বলে জানা গেছে৷জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে ছাত্রদল এবং যুবদলই মাঠে প্রতিবাদ গড়ে তুলবে৷ দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী তাই এখন পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে ভ্রাম্যমান হয়েছে৷ তাঁরা পাবলিক বাসে চলাফেরা করছেন৷
বিএনপি'র যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ এটা একটা মিথ্যা মামলা৷ এই মামলার রায় যেন পূর্ব নির্ধারিত৷ না হলে সরকারি দলের নেতারা কিভাবে বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে৷'' তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি নেতা-কর্মীদের পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় করছে৷ পুলিশের এত উৎসাহ কেন? পুলিশ সভা-সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করেছে৷ এ থেকেই বোঝা যায়, সরকার রায় আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে৷'' তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা আইনগতভাবে এই মামলা মোকাবেলা করছি৷ কিন্তু দেশে খালেদা জিয়ার কোটি কোটি ভক্ত আছে৷ বিএনপি'র কোটি কোটি ভক্ত রয়েছে৷ যদি মামলায় কোনো নেগেটিভ সিদ্ধান্ত আসে, কোটি কোটি ভক্ত কী করে না করে আমরা জানি না৷''
যে মামলায় খালেদা জিয়ার বিচার:
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই ঢাকার রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)৷
মামলায় ২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক হারুন অর রশীদ৷ ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত৷ মামলায় খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান ছাড়া বাকি আসামিরা হলেন, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান৷
৩২ জনের সাক্ষ্য এবং উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায়ের দিন ধার্য করেছেন ঢাকার বকশি বজারে বিশেষ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান৷ বিএনপি নেতারা জানান, রায়ের দিন খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত থাকবেন৷
মামলাটি দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং ১০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় করা৷ দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান আছে৷ আর দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধরায় সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে৷
খালেদা জিয়া কি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন?
খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হলেই যে তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন তা নয়৷ বাংলাদেশের সংবিধনের ৬৬(১) অনুচ্ছেদে সংসদ নির্বাচনে অযোগ্যতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর যদি পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে৷''
কিন্তু বিচারিক আদালতের রায় যদি আপিল আদালত স্থগিত করে আপিলের জন্য গ্রহণ করে, তাহলে নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য এই অনুচ্ছেদ বাধা নয়৷ তাই খালেদা জিয়ার যদি শাস্তি হয়ও, তারপরও আপিলের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন সচল রাখার ব্যাপারে আশাবাদী বিএনপি নেতারা৷
বৃহস্পতিবার ঢাকার বকশি বাজারে বিশেষ আদালতে রায় ঘোষণা করার কথা৷ আর সে কারণে ওই আদালত এবং আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা জোরাদার করা হয়েছে বলে জানান ডিএমপি'র উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান৷ তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘পুলিশ রাজনৈতিক কারণে কোনো ধরপাকড় করছে না৷ যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে৷'' বিএনপির দাবি, তাদের ১১শ' নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে৷
খালেদা জিয়ার জরুরি সংবাদ সম্মেলন:
মামলার রায় ঘোষণার আগের দিন বুধবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া৷ বিকাল ৫টায় গুলশানে বিএনপি'র চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন হবে৷ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে না জানালেও বৃহস্পতিবার তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা ও দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়েই সংবাদ সম্মেলনে কথা বলবেন বলে জানা গেছে৷