গণহত্যার সাফাই গাইতে আদালতে সু চি
১০ ডিসেম্বর ২০১৯মানবতা ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ের পুরস্কারস্বরূপ ২৮ বছর আগে যিনি শান্তিতে নোবেল জেতেন৷ গণতন্ত্রের পক্ষে অহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দি জীবন কাটানো সু চি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিলেন৷
সেই সু চি ২০১৫ সালে বিপুল ভোটে জিতে মিয়ানমারের ক্ষমতায় এসে পুরো ভোল পাল্টে ফেলেন৷
২০১৭ সালের অগাস্টে মিয়ানমারের কয়েকটি সীমান্ত স্থাপনায় 'বিচ্ছিন্নতাবাদীদের' হামলার পর পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যে বিশেষ করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সেনা অভিযান শুরু হয়৷
‘সন্ত্রাস দমনের' নামে ওই সেনা অভিযানে গণহত্যা, গণধর্ষণ, নির্যাতন এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ উঠে৷ প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়৷
কয়েকটি স্বাধীন ফ্যাক্টফাইন্ডিং কমিটি ওই অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার দাবি করেছে এবং জাতিসংঘ মিয়ানমারের সেনা অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন' বলে বর্ণনা করেছে৷ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন থেকেও অভিযানের তীব্র সমালোচনা করে জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের বিচারের দাবি করা হয়৷
নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে লাখ লাখ মানুষকে দেশ ছাড়তে দেখেও ‘নিষ্ক্রিয়' ভূমিকায় ছিলেন সু চি৷
মঙ্গলবার প্রথম দিনের শুনানিতে গাম্বিয়া নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে৷ বুধবার মিয়ানমার নিজেদের পক্ষে ব্যাখ্যা দেবে৷ তিন দিনের এ শুনানির তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার সাক্ষ্য গ্রহণ হবে৷ এজন্য বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তিন প্রতিনিধি হেগে গেছেন৷ যারা আদালতে নিজেদের উপর হওয়া নিপীড়নের বর্ণনা দেবেন৷
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আইসিজে তে এটি তৃতীয় গণহত্যা মামলার শুনানি৷
ওআইসিভুক্ত পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া গত নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তির বিধানে ১৯৪৮ সালে স্বাক্ষরিত ‘জেনোসাইড কনভেনশন' লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে এ মামলা করে৷
গাম্বিয়া নিজেও ওই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারি দেশ এবং ১৯৫৬ সাল মিয়ানমারও স্বাক্ষর করে৷
কনভেনশনের আওতায় দেশগুলো শুধু গণহত্যা থেকে বিরত থাকাই নয় বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা এবং এমন অপরাধের জন্য শাস্তি বিধানেও বাধ্য।
৫৭ সদস্যের ওআইসির বাকি সদস্যরাষ্ট্রগুলো গাম্বিয়াকে সমর্থন দিয়েছে৷ এছাড়া কানাডাও গাম্বিয়ার পক্ষে৷ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কানাডা সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাতিল করেছে৷ শান্তিতে তার নোবেল বাতিলের দাবিও উঠেছে৷
নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে করা মামলায় গাম্বিয়া মিয়ানমারে ‘এখনো গণহত্যা চলছে' অভিযোগ তুলে তা বন্ধে দেশটির বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে৷
গাম্বিয়ার মামলার পর আইসিজে থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয় এবং সু চি নিজে দেশর প্রতিনিধি দলের প্রধান হয়ে হেগে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান৷
এক সময় মানবতার পক্ষে কথা বলে বিশ্বজুড়ে নায়কের খ্যাতি পাওয়া সু চি তার দেশের সেনাবাহিনীর হত্যাযোজ্ঞের পক্ষে সাফাই দিতে আদলতে দাঁড়িয়েছেন৷ যদিও সু চির ব্যাখ্যা তিনি দেশের স্বার্থরক্ষায় আইসিজে তে এসেছেন৷
এদিকে, হেগে শুনানি শুরুর একদিন আগে থেকে রোহিঙ্গা মুসলমান সমর্থক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘বয়কট মিয়ানমার ক্যাম্পেইন' শুরু করে৷
রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে বিশ্বজুড়ে কাজ করা সংগঠন ‘দ্য ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন'(এফআরসি) এক বিবৃতিতে বলেছে, ১০টি দেশের ৩০টি মানবাধিকার সংগঠন একযোগে এ ক্যাম্পেইন শুরু করছে৷ তারা সবাইকে এই ক্যাম্পেইনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷
রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য মিয়ানমারকে বিচারের আওতায় আনতে যে ১০টি সংগঠন গাম্বিয়াকে সহায়তা করছে, তাদের একটি হল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)৷
এইচআরডব্লিউর পরিচালক পরম-প্রীত সিং এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, "গাম্বিয়ার এই আইনি পদক্ষেপের ফলে বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ এখন আদালত রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচাতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নিতে পারবে৷
১৯৯৩ সালে বসনিয়ায় গণহত্যার বিচারের শুরুতে আইসিজে সার্বিয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নিয়েছিল৷
আইসিজে মূলত প্রতিপক্ষ দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে৷ আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের শাস্তি দেয়৷
এসএনএল (রয়টার্স)