‘গায়েবি মামলায়’ গ্রেপ্তার, সাজা আর ‘বিশ্বাসঘাতকতা’
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩পুরান ঢাকায় চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে রোববার দেখা মিললো বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মীর আত্মীয়স্বজন এবং তাদের আইনজীবীদের৷ তাদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট৷ গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর গ্রেপ্তার হয়েছেন দলটির ছোটবড় অনেক নেতাকর্মী৷ একই সময়ে পুরাতন মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সাজাও দেয়া হচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে৷
ঢাকার সংবাদমাধ্যমে বিএনপিকে উদ্ধৃত করে যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২৩ হাজার ৪৬০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ এ সময়ে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৬৮৪টি মামলা হয়েছে৷ আর গত ১৬ সপ্তাহে এক হাজার ৪৮২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে৷ একই সময়ে অন্তত আটজন বিএনপি কর্মীর কারাগারে মৃত্যু হয়েছে৷
এই পরিসংখ্যান প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে৷ আদালত পাড়ায় কথা হলো বিএনপিপন্থি একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে৷ তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকেন্দ্রিক নানা ঘটনায় হওয়া মামলাগুলোতে যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই জামিন পাচ্ছেন না৷ হাতেগোনা যে কয়েকজন জামিন পেয়েছেন তাদের নির্দিষ্ট কারণে জামিন দেয়া হয়েছে৷
আইনজীবী মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ একসময় ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷ তিনি জানান যে বিএনএফের ১১ সদস্য এবং বিএনপির শাজাহান ওমরকে জামিন দেয়া হয়েছিল কেননা তারা নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয়েছিলেন৷
‘‘এটা ছাড়া সিএমএম আদালত আর জজকোর্ট থেকে আমাদের কোনো আসামিকে জামিন দেয়া হচ্ছে না,’’ বলেন তিনি৷
ইলতুৎমিশ যোগ করেন, ‘‘সহিংসতা কারা করেছে সেটা তদন্তের ব্যাপার৷ আমাদের কথা হচ্ছে, যদি এটা প্রমাণিত হয় যে কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, ঘটনা ঘটিয়েছে তাহলে তার সাজা হবে, শুনানি হবে৷ কিন্তু জামিন পাওয়াটাতো আমার অধিকার৷ সেই অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে৷''
আদালত প্রাঙ্গনে কথা হলো সুরুজ্জামানের সঙ্গে৷ তার দাবি, তুরাগ থানায় ২০১৮ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে করা ‘গায়েবি মামলায়' শতভাগ আসামিকে সাজা দেয়া হয়েছে৷ তাকেও সাজা দেয়া হয়েছে৷
নিজের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্র হাতে নিয়ে ঘুরছিলেন তিনি৷ তার বক্তব্য, যে সময় তাকে আসামি করা হয়েছিল সেসময় তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন৷
‘‘বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে৷ এখানে স্বাধীনভাবে কোনো বিচার হচ্ছে না,'' বলেন তিনি৷
সাজানো, গায়েবি মামলার যে কথা বিএনপির নেতাকর্মী, আইনজীবীরা বলছেন তার অসংখ্য উদাহরণ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে৷ তাতে অবশ্য পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না৷ বরং সেসব মামলায় শাস্তির উদাহরণ ক্রমশই বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেক আইনজীবী৷
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় বসবাস করেন মানবাধিকারকর্মী এডভোকেট সুলতানা কামাল৷ বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি তিনি৷ ব্যক্তিজীবনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী তিনি৷
তবে, ব্যক্তিগত পরিচয়কে নিজের নৈতিক অবস্থানের সঙ্গে মেলাতে রাজি নন তিনি৷ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বেশ সরব সুলতানা কামাল৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে রোববার আলাপকালে বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারে বিষয়েও খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি৷ সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘এত অপরাধ কি সংগঠিত হয়েছে এই কয়দিনে? তাহলে আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীগুলো কী করে, পুলিশের কাজটা কী? চিহ্নিত করে তারপরেতো অপরাধীদের ধরবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘যেকোনো মানুষকে ধরে নিয়ে তারপর অপরাধী প্রমাণ করাটাতো আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন, মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷ সেটাতো তারা করতে পারে না৷’’
সম্প্রতি বিএনপির অন্তত আট কর্মীর কারাগারে মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এই সমস্ত ঘটনার প্রত্যেকটির সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত৷ যদি না হয় তাহলে অবশ্যই সরকারকে এর দায় বহন করতে হবে৷’’
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে এমন আশা করছেন না এই মানবাধিকারকর্মী৷ বরং সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরো কঠোর হতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করলেন তিনি৷
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রতি ইঙ্গিত করে সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘তারাতো দাবি করেন তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি৷ আমি তাদের কাছে জোর দাবি জানাবো যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করবেন না, অসম্মান করবেন না, অবমাননা করবেন না৷’’
‘‘আপনারা যেহেতু দাবি করেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আপনারা, তাই যতটা সম্ভব পারেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছাকাছি যান, সেই চেতনার আলোকে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ চালাবেন বলেন৷ সেই আদর্শে দেশ চালানোর চেষ্টা করেন,'' বলেন তিনি৷
সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘কারণ আপনারা যা কাজ করছেন সেগুলো যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে চিহ্নিত হয়ে যায়, আপনারা চরম অবিচার করবেন৷ এবং আমাদের প্রতি এটা একটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে৷''
বর্তমান সরকার অবশ্য বারবার বলে আসছে অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের সাজা দেয়া হচ্ছে এবং নতুন যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তারাও নানা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত৷ তবে রাজনৈতিক মামলায় ঠিক কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা সাজা দেয়া হচ্ছে তা নিশ্চিত করেনি সরকার৷