গুপ্তধনের খোঁজে
২৩ জুন ২০১৪গুপ্তধন নিয়ে মানুষের কল্পনা চিরকালই যুক্তি-বুদ্ধির বাঁধনছাড়া৷ যদিও এমন একটা সময় সত্যিই ছিল, যখন গুপ্তধন উদ্ধার ছিল একটা বাস্তব ঘটনা৷ সে মিশরের পিরামিডের অভ্যন্তরের গুপ্ত কক্ষে লুকিয়ে রাখা সোনা হোক বা ইনকাদের লুকনো সোনার ভান্ডার, ডাকাতির ভয়ে মাটির তলায় পুঁতে রাখা বিত্তবানের সঞ্চয় হোক বা মাঝসাগরের কোনো নির্জন দ্বীপে জলদস্যুদের লুকিয়ে রাখা লুঠের মাল – একটা সময় দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা এই সব গুপ্তধনের হদিস পেতেন৷ হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যেত গভীর সমুদ্রে সলিল সমাধি হওয়া জলদস্যু জাহাজের গর্ভে সঞ্চিত থাকা সোনা৷ অথবা কোনো পুরনো রাজপ্রাসাদের পাতাল ঘর বা ধর্মস্থানের গুপ্ত গর্ভগৃহ থেকে আবিষ্কৃত হত গুপ্তধন! আর সেইসব ঘটনা থেকে জন্ম নিত গল্প, গুজব, রটনা৷ সাহিত্য থেকে সিনেমা, বহু কাহিনিই একসময় তৈরি হয়েছে সেই কল্পনাকে আশ্রয় করে৷
মজার কথা হচ্ছে, আধুনিক সময়ও সেই গুপ্তধনের স্বপ্নের হাতছানিকে অস্বীকার করতে পারে না৷ সম্ভবত সেটাই হয়েছিল ছয় বছর আগে, দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট অঞ্চলে একটি জমি খুঁড়তে গিয়ে শ্রমিকের শাবল-গাঁইতি শক্ত কিছুতে লেগে ঠং করে আওয়াজ তুলেছিল! গুপ্তধনের নানা সত্যি-মিথ্যে গল্পের কল্যাণে মাটির তলা থেকে এই ধাতব শব্দ পাওয়ার পরবর্তী ঘটনাগুলো সবার জানা৷ কাজেই সবাই ভেবে নিলেন, এর পরেই মাটি খুঁড়ে পাওয়া যাবে সোনার মোহরে বোঝাই পিতলের ঘড়া অথবা স্বর্ণালংকারে ভর্তি সিন্দুক অথবা হয়ত আরও দুর্মূল্য কোনো প্রত্নদ্রব্য৷ কী আশ্চর্য, হলোও তাই! মাটির গভীরে পুঁতে রাখা, একটি নয়, তিন তিনটি দশাসই চেহারার লোহার সিন্দুক উদ্ধার হলো সেখান থেকে৷ তিনটি সিন্দুকই এমন ভারি যে ‘ক্রেন' আনতে হলো তাদের জমিতে তুলে আনার জন্য৷
এবার, যে জমিটি খোঁড়া হচ্ছিল, সেটি তার কিছুদিন আগেই হাতবদল হয়েছিল৷ পুরনো মালিক যিনি, সিন্দুক উদ্ধারের খবর পেয়েই তিনি দৌড়ে আসেন এবং সিন্দুক তিনটির মালিকানা দাবি করেন৷ এদিকে যিনি জমিটি কিনেছেন, তিনি উদ্ধার হওয়া সিন্দুকের দখল ছাড়তে রাজি নন৷ কারণ দুজনেই নিঃসন্দেহে ভাবছিলেন, মাটিতে পোঁতা সিন্দুক যখন, গুপ্তধন না হয়ে যায় না! ওঁদের ঝগড়া থানা-পুলিশ এবং আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ মামলা চলে পরের ছয় বছর ধরে, সিন্দুক জমা থাকে গড়িয়াহাট থানার জিম্মায়৷ নিয়মিত আদালতে দৌড়োদৌড়ি এবং উকিলের পিছনে লক্ষাধিক টাকা খরচ করার পর, সম্প্রতি মামলার রায় যায় ওই জমির পুরনো মালিকের পক্ষে৷ কিন্তু সিন্দুকে রক্ষিত সম্পদ যে আসলে কী, তা কারো জানা না থাকায় আদালত নির্দেশ দেয় ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ, বা আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ, অর্থাৎ জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে, গড়িয়াহাট থানায় তিনটি সিন্দুক খুলে দেখা হবে৷
সংবাধমাধ্যম মারফৎ এবং লোকের মুখে মুখে সেই খবর ছড়িয়ে যায় এবং নির্ধারিত দিন সকাল থেকেই গড়িয়াহাট থানার সামনে ভিড় জমতে শুরু করে৷ সবাই স্বচক্ষে গুপ্তধন উদ্ধার দেখে জীবন সার্থক করতে এসেছে৷ একটা সময় ভিড় এমন বেড়ে যায় যে থানার ফটকের সামনে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়৷ কিন্তু লোকের উৎসাহ তাতে আদৌ কমে না বরং আশেপাশের বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, পাঁচিলে, এমনকি থানার পাঁচিলে এবং রাস্তার ধারের গাছেও লোকে চড়ে বসে থাকে৷ তার মধ্যেই সিন্দুক খোলার প্রক্রিয়া শুরু করে পুলিশ৷ প্রথমে শাবলের চাড় দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা হয়, কিন্তু মজবুত লোহার সিন্দুক তাতে এতটুকুও টোল খায় না৷ তখন নিয়ে আসা হয় বৈদ্যুতিক করাত এবং গ্যাস কাটার৷
বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টার পর প্রথম সিন্দুকটি খোলা গেলে, তার ভিতর থেকে পাওয়া যায় একটি কাগজের খামে রাখা কিছু সেলাই করার সূচ৷ আর্কিওলজিকাল সার্ভের বিশেষজ্ঞরা খতিয়ে দেখে জানান, সূচগুলি ইস্পাতের এবং সেগুলি ক্যানাডায় তৈরি৷ আপাতদৃষ্টিতে তাদের আর কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ ওই সূচ ছাড়া তিনটি সিন্দুক থেকে এর পর একে একে বেরোয় কিছু পুরনো চিঠি লেখার কাগজ এবং আরও একটি খামের মধ্যে চারটি পাঁচ টাকার নোট, অর্থাৎ সাকূল্যে মোট কুড়িটি টাকা৷ প্রথম সিন্দুকে সঞ্চিত সূচ ভাণ্ডারের খবর বাইরে আসতেই ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছিল, শেষ সিন্দুক যখন খোলা হচ্ছে, তখন বাইরে লোক প্রায় নেই!
জমির সাবেক মালিক কিঞ্চিত হা-হুতাশ করেছেন যে ছয় বছর ধরে মামলা লড়ে, বহু টাকা খরচ করেও গুপ্তধন পাওয়ার স্বপ্নের বেলুনে সূচ ফুটল! তবে সবথেকে হতাশ হয়েছেন বোধহয় ওই মানুষগুলো, যাঁরা, ওই গুপ্তধনের এক কানাকড়ি পাবেন না জেনেও ভিড় করেছিলেন, স্রেফ একটা স্বপ্নপূরণের সাক্ষী থাকতে৷