সিরিয়ায় জার্মানি প্রবাসী চিকিত্সকরা
১৩ জুন ২০১৩‘‘ব্যথার ওষুধটা যখন শেষ হয়ে গেল, রোগী তখন যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করলেন৷ কিন্তু সেলারের ধূসর আলোতেই আমরা অপারেশন চালিয়ে যেতে লাগলাম৷'' নীচুস্বরে বললেন ডা.ওমর৷ ‘‘আমাদের কোনো উপায় ছিল না৷ নয়তো মানুষটি রক্তপাত হতে হতেই মারা যেতো৷ গ্রেনেডের টুকরা লেগে তার পেট ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল৷'' সিরিয়া থেকে জার্মানিতে ফিরে আসার অনেক দিন পরও এই দুঃস্বপ্ন কাটেনি ডা. ওমরের৷
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিত্সাসেবা
তাঁর আসল নাম অবশ্য ওমর নয়৷ সিরীয় এই চিকিত্সক জার্মানির একটি ক্লিনিকে কাজ করেন৷ মা বাবা ভাই বোন রয়েছেন সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে৷ তাদের কোনো বিপদ ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় নিজের নামটি গোপন রাখতে চান তিনি৷
ফেসবুকে সিরিয়ার উত্তরে পাহাড়ি অঞ্চলের এক গ্রামে অপারেশনের জন্য একজন অভিজ্ঞ শৈল্যচিকিৎসক খোঁজা হচ্ছিল হন্যে হয়ে৷ আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক শীতের রাতে তুরস্কের সীমানা পার হয়ে সিরিয়া ঢুকে পড়েন ওমর৷ তাঁকে সাহায্য করেছেন জার্মানি ও ফ্রান্সে বসবাসকারী সিরীয় ডাক্তাররা৷ যাঁরা একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন৷ সবাই মিলে ওষুধপত্র ও ডাক্তারি যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে শত বিপদ সত্ত্বেও সীমানা পার হয়ে সিরিয়ায় পৌঁছে দেন৷
সেলারে ক্লিনিক
ডা. ওমর যে এক সপ্তাহ ধরে বোমায় বিধ্বস্ত বিভিন্ন বাড়িঘরে ও সেলারে রোগীদের চিকিৎসা করেছেন, তা জানাজানি হলে পরিবারের জন্য বিরাট বিপদ হতো৷ কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁর এক চিকিত্সক বন্ধুকে আলেপ্পোতে খুন করা হয়৷
ওমর জানান, পুলিশ তাঁর ডাক্তারখানায় এসে সরাসরি তাঁকে গুলি করে৷ তিনি আলেপ্পোর নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে একসাথে কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন৷
জার্মানির ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স'-এর প্রধান টাংকরেড স্ট্যোবে বলেন, ‘‘সিরিয়ায় হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সগুলিকে সুপরিকল্পিতভাবে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়৷ প্রায় ৬০ শতাংশ হাসপাতাল ও ৮০ শতাংশ রোগী পরিবহনকারী যান বিদ্রোহী ও সিরীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এতেই বোঝা যায়, এ সব ইচ্ছাকৃতভাবেই ঘটানো হয়েছে৷''
এই আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাটি সিরিয়ায় পাঁচটি ক্লিনিকে চিকিত্সা দিচ্ছে৷ সবগুলিই বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবস্থিত৷ সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে যাওয়ার অনুমোদন তারা পায়নি৷
গোপনে চিকিৎসা
জার্মানির ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স'-এর টিমটিকে রাতে গোপনে তুরস্কের সীমানা পার হতে হয়৷ মাঝে মাঝেই গাড়ি বদলাতে হয়৷ অপারেশনের টেবিল থেকে শুরু করে ব্যান্ডেজ, ওষুধপত্র সবই সাথে নিতে হয়৷
সিরিয়ার ওষুধপত্র উত্পাদন স্থবির হয়ে পড়েছে৷ অভাব দেখা দিয়েছে ব্যান্ডেজ সামগ্রীর৷ অনেক ডাক্তার ও নার্স পালিয়ে গেছেন৷ বাচ্চাদের টিকা দেওয়া হচ্ছে না৷
অনেক আহত ব্যক্তি রক্তপাত হতে হতে মারা গেছে৷ কেননা গ্রেনেড ও গোলাগুলির আঘাত হলে প্রতিটি মিনিটই গুরুত্বপূর্ণ৷ সাথে সাথে অপারেশন করা না গেলে জীবন বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ে৷
রোগীরা স্ট্যোবে-র ক্লিনিকে রাতে আসেন৷ অনেককে ছোট গাড়িতে বাতি নিভিয়ে আনা হয়৷ কেউ কেউ আবার হেঁটেও আসেন৷ উত্তর সিরিয়ার যাতায়াত ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে৷ অনেক রাস্তাঘাট মাইন ও গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে৷ ব্যারিকেড দেওয়ায় গ্রামগুলি বড় বড় শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ বিধ্বস্ত বাড়িঘরের গোপন স্থানে খোলা ক্লিনিকগুলিই অনেক মানুষের চিকিত্সা নেওয়ার একমাত্র পথ৷ ‘‘আসলে এইগুলিকে ক্লিনিক না বলে সেলারের একটি ঘর বলাই ভাল৷'' বলেন ডা. ওমর৷ বিদ্যুৎ মাঝে মাঝেই থাকে না৷ প্রায়ই তাঁকে টর্চের আলোতে অপারেশন করতে হয়৷
অপ্রতুল সাহায্য
ডা. ওমরকে ডাক্তারির ছাত্র ও নার্সদের নিয়ে কাজ করতে হয়েছে৷ যাদের চিকিত্সা ক্ষেত্রে সেরকম কোনো প্রস্তুতি নেই৷ প্রতি রাতেই বোমায় আহত অনেক মানুষ, সন্তানসম্ভবা নারী কিংবা হাঁপানির রোগীরা চিকিত্সার আশায় তাঁদের কাছে আসতেন৷ কিন্তু কিছুদিন পরই তুরস্কে কেনা ওষুধপত্র শেষ হয়ে যায়৷ ওমর জানান, ‘‘আমাদের চিকিত্সার যন্ত্রপাতি খুব কমই ছিল৷ অনেক কিছু জীবাণুমুক্ত করার জন্য আমরা ওভেনে গরম করতাম, এমনকি রক্তপাত বন্ধ করার জন্য রক্তনালীতে চুলের ক্লিপ দিয়ে আটকাতে হয়েছে৷'' করুণ হাসি দিয়ে তাঁর অবস্থাটা বর্ণনা করেন ডা. ওমর৷ কেনো প্রস্তুতি ছাড়াই সিরিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি৷ অবস্থা যে এতটা খারাপ তা তাঁর জানা ছিল না. অল্পের জন্য বোমার আঘাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন তিনি৷ তাঁর ভাষায় ‘‘মৃত্যু থেকে মাত্র ২০ সেকেন্ডের ব্যবধান৷'' পরের দিনই তুরস্ক হয়ে জার্মানিতে রওনা হয়ে যান তিনি৷
বিবেকের তাড়া
একটি ছয় বছরের মেয়ের চেহারা ভেসে ওঠে তাঁর মনে৷ যন্ত্রপাতির অভাবে যার পা-টাকে রক্ষা করা যায়নি, কেটে ফেলতে হয়েছে৷ যন্ত্রণাকাতর সেই মানুষটির কান্নাও ভুলতে পারেন না ওমর, যার জন্য যথেষ্ট ব্যথার ওষুধ ছিল না৷
গ্রীষ্মে তাঁর আরো এক সপ্তাহ ছুটি আছে৷ সেই ছুটিতে আবার সিরিয়ায় যাওয়ার ইচ্ছা আছে তাঁর৷ কিন্তু স্ত্রী কান্নাকাটি করেন, কাকুতিমিনতি করেন সেই বিপজ্জনক অঞ্চলে আবার না যেতে৷ পরিবার ও দুই ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে জীবনের ঝুঁকি না নিতে৷
ডা.ওমরের নিজেরও ভয় কম নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু আমি যদি জার্মানিতে থেকে যাই, তাহলে এমন সব মানুষ মারা যাবে, যাদের আমি বাঁচাতে পারতাম৷ এই সব মানুষের জন্য আমারও তো দায়িত্ব রয়েছে৷ আমি তো ডাক্তার৷''