‘জমি দখলের জন্য পরিকল্পিতভাবে গুলি করা হয়’
১০ নভেম্বর ২০১৬ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসে তিনি আরো বলেন, চিনিকল কর্তৃপক্ষ যেমনটি দাবি করেছে তা একেবারেই ঠিক নয়৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বীজ আখ কাটতে গিয়ে বাধা দেওয়ার ফলে সৃষ্ট কোনো কাকতালীয় ঘটনা ওটা নয়৷''
বুধবারই ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে ঢাকায় ফিলেছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷ হামলায় আহতদের প্রতি আচরণেও অমানবিকতা লক্ষ্য করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিমল কিসকু ও চরণ সরেণকে হাতকড়া পরা অবস্থায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের আবার হুমকিও দেয়া হচ্ছে৷''
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘‘উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার আইন আছে বাংলাদেশে৷ সেই আইন মেনে অভিযান পরিচালনা করা হয়নি৷ তাছাড়া অভিযানে ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম ছাড়া পুলিশ গুলি করতে পারে না৷''
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন লেখক ও গবেষক ড. স্বপন আদনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, মৌলিক অধিকার সুরা কমিটির সদস্য জাকির হোসেন, রেজাউর রহমান, আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী ফিরোজ আহমেদ ও সংস্কৃতিকর্মী অরূপ রাহী৷
আতঙ্কে সাঁওতাল পল্লী
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ আখের খামার এলাকার সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া এখনো থমথমে৷ বুধবার, অর্থাৎ গতকালও পুলিশের আতঙ্কে ওই দুই গ্রামের পুরুষরা বাড়ি ফেরেনি৷ তাদের ঘরে নেই খাবার৷ সবার চোখেই এক অজানা ভয়৷ আবার কখন জানি হামলা হয়, এই ভয়ে কুঁকড়ে আছেন গ্রামের বাসিন্দারা৷
দৈনিক ইত্তেফাকের গোবিন্দগঞ্জ প্রতিনিধি গোপাল মোহন্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে৷ তবে সবার মধ্যেই আতঙ্ক৷ সাঁওতালদের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না৷ যে জমি নিয়ে বিরোধ সেখানে ১০ ভাগ জমির মালিক সাঁওতালরা আর ৯০ ভাগই হিন্দু ও মুসলমানদের৷ সাঁওতালরা কিছু ক্ষতিপূরণ পেলেও বাঙালিদের দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না৷ তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে৷''
গ্রামবাসী জানায়, সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ‘ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি'-র সভাপতি শাকিল আলম বুলবুলের ইন্ধনে সাঁওতালরা বাপ-দাদার জমি ফেরত পাওয়ার আশায় ওখানে চালা ঘর তোলে৷ আবার সেই শাকিলের নেতৃত্বেই গত রবিবার চালানো হয় উচ্ছেদ অভিযান, ঘরে দেওয়া হয় আগুন৷
গোপাল মোহন্ত বলেন, ‘‘সাহেবগঞ্জ সংলগ্ন সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামে গিয়ে বুধবার দেখা গেছে সাঁওতাল পরিবারের নারীরা বাড়ির উঠোনে বসে আছেন৷ বহিরাগত লোক দেখলেই তারা আতঙ্কিত হচ্ছেন৷ গ্রাম ঘুরে দেখা গেল বেশিরভাগ সাঁওতাল পুরুষই পুলিশের ভয়ে বাড়িছাড়া৷ নারীরা অনাহারে আছেন৷''
সাঁওতালরা যা বলছেন
সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত রুমিলা কিসকু বললেন, ‘‘আমরা গরিব মানুষ৷ কৃষি কাজ করে সংসার চলে৷ গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আলম বুলবুলের কথামতো বাপ-দাদার জমি ফেরত পাবার আশায় ধার-দেনা করে চালা ঘর তোলা হয়েছিল৷ আবার তার নেতৃত্বেই চালানো হয় উচ্ছেদ, পুলিশের উপস্থিতিতে ঘরগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়৷ সেই আগুনে চাল-ডাল, লেপ-তোষক বালিশ কিছুই রক্ষা পায়নি৷ পুলিশ গুলি করে আমাদের দু'জনকে মারলো৷''
আরেকজন বললেন, ‘‘হামলার সময় দর্বৃত্তরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি লুট করে নিয়ে যায়৷ এখন সবসময় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি, কখন না জানি আবার হামলা হয়৷ এছাড়া পাওনাদারের চাপও আছে৷ ধার করা সেই টাকা কী করে পরিশোধ করবো৷ আমাদের অনেক লোককে পুলিশ আসামি করেছে৷ গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা পালিয়ে আছে৷''
সেদিন যা ঘটেছিল
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের পাশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ নিয়ে প্রশাসন ও চিনিকলের লোকজন হাজির হয়৷ উচ্ছেদের চেষ্টা করলে সাঁওতাল ও বাঙালিদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে৷ এতে আট পুলিশ সদস্য আহত হন৷ আর বাঙালি ও সাঁওতালদের অন্তত ৩০ জন আহত হন৷ মারা যান দুই জন৷ গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো চিকিৎসাধীন আছেন কয়েকজন৷ এরপর ওই পল্লীতে আগুন দিয়ে বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়৷
ওই ঘটনার পর পুলিশের ধরপাকড় ও মামলার ভয়ে এলাকার পুরুষরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে৷ চিকিৎসাধীনরাও আতঙ্কে আছেন৷ পুড়ে যাওয়া বাড়ির সামনে (উঠানে) বসে আছেন নারীরা৷ তাদের খাওয়ার মতো কিছু নেই৷
গোবিন্দগঞ্জ থানার অফিসার ইন চার্জ (ওসি) সুব্রত সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক৷ ঘরে আগুন ও লুটপাটের ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি৷ কারা আগুন দিয়েছে, তা আমরা জানি না৷''
যে কারণে এই হামলা
১৯৫৫ সালে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ওই এলাকায় ১ হাজার ৮৪০ একর জমি অধিগ্রহণ করে৷ ওইসব জমিতে উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করা হচ্ছিল বলে চিনিকল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে৷ গত ১ জুলাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন জমির একাংশে একচালা ঘর নির্মাণ করেন৷ ওই সময়ই তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়৷
সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার কমিটির সহ-সভাপতি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের সময় চুক্তিপত্রে উল্লেখ করেছিল কখনো ওই সব জমিতে আখ ছাড়া অন্য ফসলের চাষ হলে প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দেওয়া হবে৷ কিন্তু কিছুদিন ধরে ওই সব জমিতে ধান ও তামাক চাষ হচ্ছে৷ অথচ জমি ফেরত দেওয়া হচ্ছে না৷ এ নিয়ে আন্দোলন করেও কাজ হয়নি৷ তাই তারা জমিতে ঘর তৈরি করেছেন৷''
তবে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়াল বলেন, ‘‘অভিযোগটি ভিত্তিহীন৷ অধিগ্রহণের সময় চুক্তিনামায় বলা হয়, কখনো চিনিকল বা খামার বন্ধ হলে সে ক্ষেত্রে ওই সব জমি সরকারের কাছে চলে যাবে৷ ফেরত দেয়ার কথা বলা হয়নি৷''
বিষয়টি নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে? জানান নীচের ঘরে৷