গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ শতাব্দী প্রাচীন মোহনবাগান
১৮ জুলাই ২০১৮ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের নামটা এক ভিন্ন মাত্রায় জড়িয়ে রয়েছে৷ শুধু ফুটবল মাঠের সাফল্যের নিরিখে নয়, ইতিহাসের সঙ্গেও তার যোগ৷ নিজেদের জাতীয় ক্লাবের সমর্থক বলতে ভালোবাসেন মোহনবাগান অনুরাগীরা৷ অতীতের গোষ্ঠপাল, শিবদাস ভাদুড়ি এবং অধুনা শৈলেন মান্নার সেই ক্লাব ঘিরে চূড়ান্ত ডামাডোল৷ কে ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন – লড়াই তাই নিয়ে৷
বার্ষিক সাধারণ সভায় লজ্জাজনক ঘটনা
২৩ জুন বার্ষিক সাধারণ সভায় স্বপনসাধন ওরফে টুটু বসু ও অঞ্জন মিত্রের গোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা হয়৷ চিৎকার থেকে ঠেলাঠেলি, হাতাহাতি কিছুই বাদ যায়নি৷ সভাপতি টুটু বসু ও সচিব অঞ্জন মিত্রের শিবিরের মধ্যে জোরালো দ্বন্দ্ব দেখা দেবে, তার আঁচ আগেই করা গিয়েছিল৷ সে কারণেই মোতায়েন ছিল পুলিশ৷ কিন্তু দু' পক্ষের এমন ধুন্ধুমার কোন্দলে আহত হলেন কয়েকজন৷ অসুস্থ সচিব কেঁদে ফেললেন৷ সভাপতি দেখলেন, মঞ্চে তাঁর জন্য কোনো চেয়ারই নেই৷ অঞ্জনের জামাই প্রাক্তন ফুটবলার কল্যাণ চৌবেকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ উঠলো টুটু-পুত্র সহসচিব সৃঞ্জয় বসুর বিরুদ্ধে৷
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যে ক্লাবের কথা লেখা রয়েছে, গোরাদের খালি পায়ে হারানোর কৃত্বিত্ব যাদের, সেই ক্লাবে এই ধরনের পরিস্থিতি একেবারেই অনভিপ্রেত৷ বরং বলা ভালো, এ ধরনের ঘটনায় মোহনবাগানের গৌরবই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই!
সেদিনের ঘটনার সাক্ষী প্রাক্তন ফুটবলার ও বর্তমান সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷ প্রসূন বলেন, ‘‘আমি মনে-প্রাণে মোহনবাগানি৷ ১৭ বছর ক্লাবে খেলেছি এবং ৩০ বছরের মেম্বার৷ এজিএম-এ একজন সাধারণ সদস্য হিসেবেই গিয়েছিলাম, সেখানে আমাকে অপমান করা হয়েছে৷''
খেলোয়াড়ি জীবনে অজস্রবার ইস্টবেঙ্গলে খেলার অফার ফেরানো এই ফুটবলারের দাবি, সেদিন তাঁকে অপমান করেছে সচিব স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মোহন বাগানের ফুটবল সচিব স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই৷ সভার মঞ্চে দু’জনেই তর্কে জড়িয়ে পড়েন৷ শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়৷
এ প্রসঙ্গে প্রসূনের দাবি, ‘‘উনি আমার উদ্দেশ্যে বলেন, প্রসূন ঘোলা জলে মাছ ধরছেন৷ এত বছর পর নিজের ক্লাবে দাঁড়িয়ে এ কথা শুনতে হওয়ায় আমি খুবই ব্যথিত৷''
আদালতের নির্দেশ
মোহনবাগানের অভ্যন্তরীণ লড়াই ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে আদালতে৷ হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে অচলাবস্থা কাটাতে দ্রুত নির্বাচন করতে হবে ক্লাবে৷ নির্বাচনের আর্জি জানিয়ে আপাতত মামলা করেছিলেন মোহনবাগানের দুই কর্তা দেবাশিস দত্ত ও মহেশ টেকরিওয়াল৷ সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বলেছে, দুই শিবিরকে আলোচনায় বসে সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে হবে৷ নইলে নির্বাচন করতে হবে৷
আদালতের নির্দেশে টুটু বসুরা স্বস্তি পেয়েছেন৷ অঞ্জন মিত্র গোষ্ঠীর সান্ত্বনা, কোন বিচারপতিদের তত্ত্বাবধানে ক্লাবে নির্বাচন হবে, তা ঠিক করবেন ক্ষমতাসীন কর্তারা৷
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতের এই নির্দেশকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন৷ তাঁর মতে, ‘‘নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে ভোট নেওয়াই তো ভালো৷ ব্যক্তিগত লডাইয়ের জন্য ক্লাবের ক্ষতি করার কোনো মানে হয় না৷ তার বদলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সদস্যরা যাঁদের বেছে নেবেন, সবার উচিত তাঁদের মেনে নেওয়া৷'' বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন হওয়ায় মোহনবাগানের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী গোষ্ঠী, কেউই মুখ খুলতে রাজি নয়৷ প্রত্যেকেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন৷ যাঁরা এই আই.ই প্রক্রিয়ার বাইরে, তাদের অনেকেও কিছুটা উদাসীন৷ যেমন, ‘আজীবন মোহনবাগান' হিসেবে পরিচিত, প্রাক্তন ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য৷ টেলিফোনে তাঁর প্রতিক্রিয়া চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না৷ আমি ক্লাবেও যাই না এখন৷ ওরা যা করছে করুক৷ এর সঙ্গে আমি জড়াতে চাই না৷''
সুব্রত ভট্টাচার্যের বক্তব্যে আদ্যন্ত এক মোহনবাগানির যে হতাশা রয়েছে, অতীতের আরেক তারকা বিদেশ বসু ততটা নির্লিপ্ত নন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি ১১ বছর মোহনবাগানে খেলেছি৷ এই ক্লাব গঙ্গার মতো, একে কালিমালিপ্ত করা সহজ নয়৷ ক্লাব সব গ্লানি ধুয়েমুছে দেবে৷ আমরা থাকব না, কিন্তু মোহনবাগান থাকবে৷ ক্লাবের মর্যাদা কখনো ক্ষুণ্ণ হবে না৷''
এসবের মাঝে কী বলছেন ক্লাবের সমর্থক বা সদস্যরা? মোহনবাগান ক্লাবে গিয়ে দেখে বোঝারই উপায় নেই যে, ভেতরে ভেতরে এত আলোড়ন চলছে৷ এক সদস্যকে প্রশ্ন করার পরও যখন তিনি মুখ খুলতে চাইলেন না, তখনই বোঝা গেল ক্লাবের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ বেশ থমথমে৷ কানাঘুষোয় শোনা গেল, ‘নর্থইস্ট শাটলস' সংস্থার এমডি ও চেয়ারম্যান উমাশঙ্কর রায় নতুন সহ-সভাপতি হয়েছেন এবং ক্লাবকে তিনি ৩ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন৷ গুজব ছড়িয়েছে, উমাশঙ্করের এই সংস্থাই মোহনবাগানের নতুন কো-স্পন্সর হয়েছে৷
আসলে চূড়ান্ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই স্পন্সর বা কো-স্পন্সরদের সঙ্গে আইনত চুক্তি করা যাচ্ছে না৷ তাই আপাতত অনুদান হিসেবে টাকাটা দেখানো হচ্ছে৷ পাশের ক্লাব চিরশত্রু ইস্টবেঙ্গল যখন কোস্টারিকার বিশ্বকাপারকে সই করিয়ে, আইএসএলে খেলার দিকে পা বাড়িয়েছে, তখন কি মোহনবাগান গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে আবদ্ধ থাকবে?
ক্লাব চত্বরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাসক শিবিরের ঘনিষ্ঠ একজন অবশ্য দাবি করেছেন, ২৯ জুলাই মোহনবাগান দিবসে ঘোষণা হবে নতুন স্পন্সরের নাম৷ কলকাতা লিগ চলাকালীনই মোহনবাগানের চুক্তি হয়ে যাবে বিদেশিদের সঙ্গে৷ ইস্টবেঙ্গলের মতো মোহনবাগানেও আসতে পারে বিশ্বকাপে খেলা ফুটবলার৷ রয়েছে আইএসএল খেলারও সম্ভাবনা৷
‘মোহনবাগান ক্লাব মায়ের মতো'
এদিকে মোহনবাগানের একাধিক সমর্থক জানালেন তাঁরা ক্লাব পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ৷ ‘ভিভাসিয়াস মোহনবাগান' ফ্যান ক্লাবের সভাপতি শেখর মণ্ডল ডয়চে ভেলেকে বললেন,‘‘ক্লাবের উত্থান-পতন থাকবেই৷ ম্যানেজমেন্ট তার মতো চলুক৷ কে ক্লাব চালাচ্ছে তা দেখার দরকার নেই৷ আমাদের সবুজ-মেরুন দল সাফল্য পেলেই হলো৷ '' তাঁর কাছে, মোহনবাগান ক্লাব ‘মায়ের মতো'৷
বন্ধু, লেখাটা কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷