গ্যাস সংকটে বিপর্যয়ে শিল্প, আবারও দাম বৃদ্ধির ইঙ্গিত
১৫ জানুয়ারি ২০২২সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে৷ জানা গেছে, চাহিদার চেয়ে সরবরাহের পরিমাণ প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে গেছে৷ আগামী দুই সপ্তাহে তা আরো বাড়তে পারে৷ এরপর ঘাটতি কিছুটা কমার পূর্বাভাস থাকলেও চাহিদার এক চতুর্থাংশের জোগান দেয়া শিগগিরই সম্ভব হবে না৷ পরিস্থিতি সামলাতে কাতার এবং ওমান থেকে ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিমাণ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার৷ তবে তা খুব সহসাই সম্ভব হবে না৷ যার কারণে এই সংকট দ্রুত কমার সম্ভাবনা নেই৷
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আজকেই আমি বিদেশী ক্রেতাদের নিয়ে ফ্যাক্টরিতে গিয়ে দেখি ডায়িং বন্ধ৷ তখন সংশ্লিষ্টরা আমাকে জানাল, গ্যাসের সংকটের কারণে ডায়িং বন্ধ হয়ে গেছে৷ এখন এই পরিস্থিতিতে সঠিক সময়ে বিদেশে কিভাবে পণ্য পাঠানো যাবে? অথচ এখন আমাদের অর্ডারও বেশি৷ আমি সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজ খবর নিচ্ছি৷ অন্যদের সমস্যাগুলো জেনে খুব শিগগিরই পেট্রোবাংলা বা তিতাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা বসব৷’’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গত বুধবার তার ফেসবুক পেইজে একটা পোস্টে বলেছেন, ‘‘কারিগরি কারণে ১২ থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিতাস গ্যাস অন্তর্গত এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করতে পারে৷ এজন্য তিতাস কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করছে৷’’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার এক তৃতীয়াংশে নেমে গেছে৷ ফলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে না শিল্প, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসহ শহর-গ্রামের নাগরিকরা৷ উৎপাদনের চাকা ধীর ও বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ পরিবহণ খাতে রেশনিং করে সিএনজি সরবরাহ করায় বেড়ে গেছে যাতায়াতের খরচ৷ হ্রাস পেয়েছে কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সার উৎপাদনও৷
গ্যাস সংকটের কারণে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, নিটিং কারখানাগুলোর সংকট চরম আকার নিয়েছে৷ ঠিক সময়ে পণ্য দিতে না পারার ঝুঁকিতে থাকা রপ্তানিকারকরা ক্রয়াদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছেন৷ তারা বলছেন, গ্যাস সংকটের স্থায়ী সমাধান দরকার৷ ঘাটতি দ্রুত মেটানো না গেলে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে দৈনিক ৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে৷ অথচ পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস৷ গত দুই-তিন বছর ধরে দৈনিক ৪১০-৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার ৩১০ থেকে ৩৩০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছিল৷ গত ৯ জানুয়ারি ২৫৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়৷ গত ১৮ নভেম্বর সামিটের এলএনজি টার্মিনালের মুরিং ছিড়ে যায়৷ এতে টার্মিনালটিতে কোন এলএনজিবাহী কার্গো ভিড়তে পারছে না৷ এতে দৈনিক প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে৷ এতে শিল্পের পাশাপাশি রাজধানীর বহু এলাকায় বাসাবাড়িতে দিনের অধিকাংশ সময়ে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না৷ কোথাও পাওয়া গেলেও গ্যাসের চাপ থাকছে কম৷
শিল্প-কারখানায় গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)৷ সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, গ্যাস সংকট এখন তীব্রতর হয়েছে৷ এতে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না৷ অথচ কয়েকদফা গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে সরকার৷
এদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়াতে চায়৷ গ্যাসের দাম সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে তারা৷ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তারা আমাদের কাছে সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল৷ কিন্তু আইনগতভাবে আমাদের পক্ষে সমন্বয়ের সুযোগ নেই৷ হয় দাম বাড়াতে হবে, নতুবা কমাতে হবে৷ আমরা এটা পারি৷ যে কারণে তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে আইনগতভাবে আবেদন করতে বলা হয়েছে৷ তাদের আবেদন আসলে আমরা গণশুনানিসহ যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার সেগুলো নেওয়া হবে৷ আর একথাও তো সত্যি সারা বিশ্বেই গ্যাসের দাম বাড়ছে৷ ফলে এগুলোও তো আমাদের ভাবতে হবে৷'' এদিকে দুই একদিনের মধ্যেই বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির আবেদন জমা দিবে বলে জানা গেছে৷
জ্বালানি খাতের শীর্ষ সংস্থা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেছেন, দেশের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং এলএনজি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে৷ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবধরণের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ কয়েকটি গ্যাস কূপের ওয়ার্কওভার (সংস্কার) শেষ হওয়ার পথে৷ সেগুলোতে উৎপাদন শুরু ও বাড়লে সংকট কমবে৷ সামিটের এলএনজি ফের চালু হলেও সরবরাহ বাড়বে৷ এক্ষেত্রে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে৷