চা – তোমাকেই চাই
২৯ ডিসেম্বর ২০১৩ভারতীয় উপমহাদেশে চা যেন স্রেফ চা নয়, প্রধান পানীয় হিসেবে জাতীয় জীবনধারার সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার৷ সকালে হোক বা বিকেলে, বৃষ্টি পড়া মেঘলা দিন হোক বা রোদ মাখা ঝলমলে দিন – এক পেয়ালা ধোঁয়া ওঠা চা মনের সব ক্লান্তি দূরে সরিয়ে দেহমনকে করে তোলে চাঙ্গা৷ শুধু এনার্জি আনে না, এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান রক্তের দূষিত কণা সাফ করে৷ স্বল্পদামের এই পানীয়ের কদর বাড়ছে দিনে দিনে৷ সেইসঙ্গে বাড়ছে ভারতীয় চা বিশেষ করে দার্জিলিং চায়ের রপ্তানি বাজার৷ উপমহাদেশ ছাড়াও জার্মানিসহ প্রায় গোটা ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে ভারতীয় চায়ের গুণমান মন কেড়ে নিয়েছে বিদেশি চা প্রেমিকদের৷ ভারতীয় চায়ের বৈচিত্র্য অনন্য৷ সেটা গ্রীন চা-ই হোক কিংবা সিটিসি চা বা সুবাসিত দার্জিলিং চা৷
ডুয়ার্স ও দার্জিলিং-এর রাস্তার দুপাশে মাইলের পর মাইল সমান মাপে ছাঁটা চা গাছের ঘন সবুজ গালিচায় মোড়া দৃশ্যে নগর জীবনের দুষণ-ক্লান্ত চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়৷ দিগন্ত প্রসারি চা বাগানের মাঝে মাঝে মাথা তোলা মাঝারি মাপের ছায়াতরু দেখে জানতে চাইলে স্থানীয় মানুষজনের উত্তর – চা গাছ বড় আদুরে, রোদ সহ্য করতে পারে না৷ ঐসব গাছ ওদের ছায়া দেয়৷
দার্জিলিং-এর একটি চা বাগানের মালিক ঐ এলাকার এক বড় ব্যবসায়ী জে. রাই ডয়চে ভেলেকে ডুয়ার্স ও দার্জিলিং-এর বৈচিত্র্য ও গুণাগুণ প্রসঙ্গে জানালেন, সিটিসি হলো গুঁড়ো চা, চলতি কথায় যাকে বলে দুধ- চা৷ টি-ব্যাগে বেশি ব্যবহৃত হয়৷
আর অর্থোডক্স চা বলতে বোঝায়, বিনা দুধের দার্জিলিং চা৷ এই চায়ের প্রক্রিয়াকরণ হয় পাঁচ ধাপে৷ এর গুণমান নির্ভর করে বৃষ্টি, মাটি, ঠাণ্ডা হাওয়া ও চা পাতা তোলার বিশেষ পদ্ধতির ওপর৷ আর ঔষধি গুণযুক্ত গ্রীন টি খেতে হয় দুধ ও চিনি ছাড়া৷ এতে দেহের কিডনি, লিভার ভালো থাকে৷ পরিবেশবাদীদের কথা মাথায় রেখে মকাইবাড়ির চা-এর বৈশিষ্ট্য হলো, এই চা গাছে বা পাতায় কোনোরকম কীটনাশক ওষুধ ছেটানো হয় না, বললেন চা বাগানের মালিক জে. রাই৷ অনন্য বৈশিষ্টের জন্য দার্জিলিং চা বিশ্বের অন্য কোথাও হয় না৷ যেমন, শ্যাম্পেনের মৌলিকত্ব থাকে শুধু ফ্রান্সের তৈরি শ্যাম্পেনে৷ বৃষ্টি ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের ঢালে এই চা হয়৷ বৃষ্টি হবে, কিন্তু জল দাঁড়াবে না৷
আসল দার্জিলিং চায়ের পাতা হাতে তুলে হাতে মুড়ে রোদে শুকাতে হয়৷ চায়ের রং হয় সাদাটে৷ ওলং নামে আর এক ধরণের দার্জিলিং চায়ের রং হয় কমলা৷
উল্লেখ্য, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দার্জিলিং চাকে পৃথক পেটেন্ট দিয়েছে এর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য৷
২০০৯-১০ সালের হিসেবে ভারতে মোট চা উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ ৮০ হাজার টনের মত৷ বিশ্বের মোট চা উৎপাদনের প্রায় ৩৫ শতাংশ৷ স্বাধীনতার পর তা বেড়েছে ২৫০ শতাংশ৷ বেশি উৎপাদন হয় পূর্ব ভারতের আসাম ও পশ্চিম বঙ্গের ডুয়ার্স, তরাই ও দার্জিলিং জেলায়৷ আর দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পাহাড়ি অঞ্চলে৷
উত্তরবঙ্গে এখন ভাল চা তৈরি হচ্ছে৷ বিশ্বের নজর কেড়েছিল একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ এখন উত্তরবঙ্গের চা শিল্প রপ্তানি বাণিজ্যে পাখির চোখ করতে চেষ্টা চালাচ্ছে রাশিয়াকে৷ বিক্রির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ বিদেশি মুদ্রায় আয় হয় গড়ে বছরে ১,৮৫০ কোটি টাকার মতো৷ চা শিল্প কার্যত শ্রমিক-প্রধান৷ মেশিন-নির্ভর নয়, মানব-শ্রমিক নির্ভর৷ প্রায় ১১-১২ লাখ শ্রমিকের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী৷
ভারতে চা শিল্পের ইতিহাস দীর্ঘ৷ এর পত্তন ১৮২০-এর দশকে ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে৷ চীনের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চীনেরই চা-চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করে ইংরেজরা৷ আজকের ভারতীয় চা শিল্পের সূত্রপাত ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায়৷