চাকরি এবং বিয়ের নামে পতিতাবৃত্তি
২৬ আগস্ট ২০১০এ ধরণের ঘটনা কিন্তু এই প্রথম নয়৷ বুলগেরিয়া থেকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে বেশ কিছু মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল জার্মানিতে৷ বলা হয়েছিল, তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে জার্মান কিছু তরুণ৷ কিছু মেয়েকে বলা হয়েছিল, চাকরির সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে জার্মানিতে৷ মেয়েগুলো বিশ্বাস করেছিল৷ পা রেখেছিল এই ফাঁদে৷ দারিদ্র্যের তাড়নায় এসব মেয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল৷
কিন্তু বাস্তব চিত্র এই মেয়েগুলোর কাছে ধরা পড়েছিল ভিন্নভাবে৷ বিয়ে বা চাকরি – কোনোটাই তাদের হয় নি৷ প্রতিদিন তাদের ওপর চালানো হত অমানবিক নির্যাতন৷ বনে নারী পাচারকারীদের কাজই ছিল পূর্ব ইউরোপ থেকে অল্পবয়স্ক মেয়েদের ধরে আনা, নির্যাতন করা এবং পতিতা হিসেবে কাজে লাগানো৷ পুলিশ কমিশনর রাইনার বেল জানালেন, কীভাবে মেয়েদের আটকে রাখা হয়েছিল৷
রাইনার বেল জানান, ‘‘যেসব জায়গায় মেয়েদের রাখা হয়েছিল, সেগুলো ছিল পুরনো বাড়ি বা পুরোনো হোটেল৷ একেকটি ঘরে বেশ কয়েকজন মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছিল৷ সবাইকে একটি ঘরে থাকতে হয়েছে – সেটা খুবই অস্বাস্থ্যকর একটি পরিবেশ৷ সেসব মেয়েকে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে – কখনো কোলনে, কখনো বন শহরে৷ শুধু ঘুমানোর জন্য তারা বাড়িতে বা হোটেলে ফিরে আসে৷ দিনের পর দিন এভাবেই চলতো৷''
২০০৯ সালে মানুষ পাচারকারীর ওপর একটি জরিপ প্রকাশিত হয়েছে৷ তাতে উল্লেখ করা হয়, জোর করে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে – এমন ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং এসব তদন্তের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ৷ প্রায় ৫৩৪টি বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে৷ তবে তদন্তের আড়ালে রয়ে গেছে বেশির ভাগ ঘটনাই৷ সেগুলোর খবরও কেউ জানে না৷
বন-কোলনের যৌন পল্লী
বন শহরের পুলিশ কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েক বছর ধরেই বন ও কোলনে এই ধরণের কার্যকলাপের উপর নজর রাখছিল৷ কোনো স্থায়ী যৌনপল্লিতে নয় – অনেক নির্জন রাস্তার ধারে বড় গাড়ির মধ্যেই চলে এমন কার্যকলাপ৷ এর ফলেই তারা ধরতে পেরেছে পাচারকারীদের৷ তারা বুলগেরিয়ার নাগরিক৷ তাদের হাত থেকে ১০ থেকে ১৫ জন যৌন কর্মীকে উদ্ধার করা হয়৷ তাদের মধ্যে একজনের বয়স মাত্র ১৭৷
ঐ জরিপে আরো বলা হয়, যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা এবং যাদের ধরে আনা হয় – তারা বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়ার নাগরিক৷ দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে এই মেয়েগুলো দেশ ছেড়েছে৷ কথাগুলো জানান রাইনার বেল৷ যে লোকটি মেয়েদের মিথ্যে কথা বলে নিয়ে এসেছে, সে নিজেই গ্রামে গ্রামে যেয়ে মেয়েদের বাছাই করে৷ এভাবেই সে ধরে এনেছিল বুলগেরিয়ার ইভা জাহারিয়েভাকে৷ ইভার বয়স ২৬৷ সৌভাগ্যবশত তাকে আর পতিতা হয়ে কাজ করতে হবে না৷ তাকে উদ্ধার করা হয়েছে৷ সে ফিরে যেতে পারবে তাঁর গ্রামে, স্লিভেনে৷
ইভার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
ইভা বললেন তাঁর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা,‘‘ বুলগেরিয়ার অসহায়, দরিদ্র মেয়ে খুঁজে বের করা খুব সহজ৷ আমার বাবা-মা কখনোই আমার দিকে নজর দেয়নি৷ আমার বয়স যখন মাত্র ৮, তখন আমার মা সব সময়ই আমাকে একা ফেলে রেখে যেত৷ অথবা আমাকে বাবার কাছে রেখে যেত৷ আমার বাবা সারাক্ষণই মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকতো আর আমাকে মারতো৷ আমার বয়স যখন ১৫ তখন আমি একটি ডিস্কো বারে কাজ শুরু করি৷ একদিন ভোরে আমি কাজ শেষে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলাম৷ তখন একটি লোক আমার দিকে এগিয়ে আসে৷ সে কোনো কথা না বলেই সোজা একটি চড় কষে দেয়৷ আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে জোর করে গাড়িতে তোলা হয়৷ আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলে৷ বলা হয়, নেদারল্যান্ডসে আমাকে পতিতা হিসেবে কাজ করতে হবে৷ আমি যতবারই চিৎকার করে এই কাজ করতে অস্বীকার করছিলাম ততবারই লোকটি আমাকে মারছিল৷''
ইভার মত আরো অনেক মেয়েকে পুলিশ উদ্ধার করেছে৷ তাদের কারো কাছেই পাসপোর্ট নেই৷ তাদের ভাগ্যে ভবিষ্যতে আর কী লেখা রয়েছে কেউ-ই জানে না৷ সবাই ভয় পাচ্ছে দেশে ফিরে যেতে৷ কারণ পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত এমন লোকের অভাব নেই দেশে৷
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন