চাপা দেওয়ার নীতিই জনঅসন্তোষের মূল কারণ
২১ আগস্ট ২০১৮সরকার এই নীতি অনুসরণ করছে প্রথম থেকেই৷ সমস্যা হচ্ছে, তাতেও মানুষকে মনে রাখানো যাচ্ছে না৷ মুখে স্বীকার না করলেও সরকারের ভেতরের ভাবনাটা এমন যে, ‘‘এত উন্নয়ন করলাম, তবুও মানুষ খুশি নয় কেন ?''
কেন মানুষের ভেতরে এত অসন্তোষ? ভেতরে ভেতরে বিশ্লেষণও আছে সরকারের৷ তবে সেই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দিক নির্দেশনা নেই৷ সরকারের ভেতরের সিদ্ধান্তটি সম্ভবত এমন যে, মানুষের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে কাজ (উন্নয়ন) করে যেতে হবে৷
এরফলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকার জনগণ থেকে আলাদা হয়ে গেছে৷ মানুষের অসন্তোষ সুযোগ পেলেই প্রকাশ হয়ে পড়ছে৷ যতবার প্রকাশিত হচ্ছে, সরকার ততবার চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ চাপা দেওয়ার নীতিতে তাৎক্ষণিক ফল মিললেও, দীর্ঘমেয়াদে বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে৷
সম্প্রতিক দু'টি ইস্যুর প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে৷
১. কোটা সংস্কার আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না৷ দাবি যৌক্তিক হওয়ায় এ আন্দোলন প্রায় সব শিক্ষার্থীর সমর্থন পেয়েছে৷ শিক্ষার্থীরা এটা তাদের নিজেদের দাবি মনে করেছে৷ দেশের অধিকাংশ মানুষ তা সমর্থন করেছে৷
জনসমর্থিত এই আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ৷ ছাত্রসমাজের বিপক্ষে ছাত্রলীগের অবস্থান, যদি কোনোদিন নিজেরা মূল্যায়ন করে, নিঃসন্দেহে ‘মহাভুল' হিসেবে তা নিহ্নিত হবে৷
ছাত্রলীগ শুধু ছাত্র সমাজের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়নি, দমন-পীড়ন করেছে দানবীয়ভাবে৷ সরকার পুলিশ দিয়ে ছাত্রলীগের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে৷
আবার আন্দোলনের জনসমর্থন দেখে সরকার দাবির যৌক্তিকতাও স্বীকার করেছে৷ এক পর্যায়ে বলেছে, ‘কোটাই থাকবে না', ‘কোটা বাতিল হয়ে গেছে'৷
বাস্তবে কোটা সংস্কার বা বাতিলের কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে আদালতের প্রসঙ্গ সামনে এনেছে৷‘বাতিল হয়ে গেছে'- বলার পর, আবার বলেছে ‘বাতিল করা যাবে না'৷ আদালতের নির্দেশনার কথা বললেও, বাস্তবে আদালতের এমন কোনো নির্দেশনার অস্তিত্ব নেই৷
২. স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোরদের প্রতিবাদ তো ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল৷ এই প্রতিবাদ-আন্দোলনও সরকারবিরোধী ছিল না৷ কিন্তু সরকার ছাত্রলীগ এবং পুলিশি কর্মকাণ্ড দিয়ে তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করেছিল৷ ‘‘দাবি মেনে নিলাম, ঘরে ফিরে যাও''- সরকারের এ কথা শিশু-কিশোররা বিশ্বাস করেনি৷
নির্যাতন-নিপীড়নের এক পর্যায়ে শিশুরা ঘরে ফিরে গেছে৷ কিন্তু পুলিশ-হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব তাদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে৷ তারা সরকারের প্রতি অখুশি হয়েই রাস্তা ছেড়েছে৷ এই আন্দোলনটির সঙ্গে দেশের প্রায় সব মানুষ একমত পোষণ করেছে৷ সরকারের দমণ-পীড়ন নীতিতে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, অভিভাবকরাও অসন্তুষ্ট হয়েছে৷
৩. এই দুটি আন্দোলন ও তা দমন করার ধরনের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া থাক৷
ক. সরকার প্রথমে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সব কিছু ঠিক আছে৷ আন্দোলনের দরকার নেই৷ আন্দোলন যখন বেগবান হয় তখনকার কৌশল, ঠিক আছে দাবি মেনে নিলাম৷
খ. আন্দোলন থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য এর মধ্যে জামায়াত-শিবির-বিএনপি ঢুকে গেছে,এমন রাজনৈতিক বক্তব্য জোরদার করতে থাকে সরকারের মন্ত্রী ও দলের নেতারা৷
গ. জামায়াত-বিএনপি ছাত্রদের ব্যবহার করে সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করছে৷ ছাত্রদের ভুলভাবে বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে৷ এমন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগে যায় সরকার৷ পুলিশ এবং নিজেদের ছাত্র সংগঠন দিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালানো হয়৷ একটা সহিংস অবস্থা তৈরি করা হয়৷
ঘ. সহিংসতা করে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে জামায়াত- বিএনপি৷ তারা একটি ভালো আন্দোলন নষ্ট করে দিলো৷এসব কথা একনাগারে সরকারের সবাই মিলে এমনভাবে বলতে থাকে যে, ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যেন পুরো আন্দোলনটি করেছে জামায়াত-বিএনপি৷ সাধারণ ছাত্রদের তারা ভুল বুঝিয়ে আন্দোলন করিয়েছে, দায় চাপাতে গিয়ে কৃতিত্ব পুরোটা জামায়াত-বিএনপিকে দিয়ে দেয়৷ এতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভেতরে অসন্তোষ তৈরি হয়৷
৪. কোটা সংস্কার এবং স্কুল-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করেছে সরকার৷ সহিংসতা করেছে ছাত্রলীগ, সরকার দায় জামায়াত-বিএনপির উপর চাপিয়ে আন্দোলনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে৷ বাস্তবে মানুষের মনোভাবে তা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে৷ গুম-গ্রেপ্তার নির্যাতন-নিপীড়ন করে আন্দোলন চাপা দেওয়ার নীতি নিয়েছে৷
৫. সাময়িক সাফল্য পেয়েছে সরকার৷ কিন্তু এর প্রেক্ষিতে জনআন্দোলনের মাত্রা বেড়েছে৷ মানুষের ভেতরে এই ধারণা স্থায়ী হয়ে গেছে যে, সরকারের কাছে কোনো ন্যায্যতা নেই৷ সরকার কথা দিয়ে কোনো কথা রাখে না৷ কৌশলের অংশ হিসেবে কথা দেয়৷ বিপদ কেটে গেলে সেই কথার জায়গা থেকে সরে আসে৷
৬. সরকারের ‘উন্নয়ন'র গল্প মানুষের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি৷ দুর্নীতি বা আর্থিক খাতের অনিয়ম-জালিয়াতির সংবাদে মানুষ বিচলিত হয়েছে৷ নির্বাচনগুলোতে ভোট দিতে না পারায় মানুষ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছে৷ আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে, এই বিশ্বাস মানুষের মনে নেই৷
সব সময় দৃশ্যমান না হলেও একটা তীব্র জনঅসন্তোষ বিরাজ করছে৷ সুযোগ পেলেই তার প্রকাশ ঘটছে৷ জনঅসন্তোষ দূর করার কোনো চেষ্টা সরকারের নীতিতে আছে, তা দৃশ্যমান নয়৷ বল প্রয়োগ করে দাবিয়ে রাখার নীতি দৃশ্যমান৷ এমন পরিস্থিতি সামনে আসছে জাতীয় নির্বাচন৷ বিরাজমান জনঅসন্তোষ নিয়ে সরকারের ভেতরে ভয় কাজ করছে৷ মুখে তা স্বীকার না করলেও, নানা রকমের শঙ্কা সরকারের ভেতরে-বাইরে সর্বত্রই আছে৷