1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চিকিৎসা হোক সমস্যা দেখে, চেহারা দেখে নয়

প্রভাষ আমিন
১২ জুন ২০২০

অল্পের জন্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া রোগের নাম কোভিড টি-২০ হয়নি৷ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসটি শনাক্ত হয়৷ একদিন পর শনাক্ত হলেই এর নাম পাল্টে যেতে পারতো৷

https://p.dw.com/p/3dfl3
Bangladesch Dhaka | Coronavirus | Gesundheitscheck für Arme
ছবি: Reuters/M.P. Hossain

অবশ্য ৩১ ডিসেম্বর শনাক্ত হলেও এটির উৎপত্তি আরো আগেই৷

নাম কোভিড-১৯ হলেও অনেকের ধারণা ছিল এটির আচরণ হবে টি-২০ এর মতো৷ ঝড়ের মতো এসে ঝড়ের মতো চলে যাবে৷ কিন্তু করোনা নিয়ে আরো অনেক ধারণার মতো এই ধারণাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে৷ ঝড়ের মতো এসেছে বটে, তবে গোটা বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েও প্রলয়নাচন থামেনি৷ টি-২০ তো নয়ই, এমনকি দিন নির্ধারিত টেস্টও নয়, এ যেন অন্তহীন এক নিষ্ঠুর খেলা৷ কোথায় থামবে কেউ জানে না৷ ক্রিকেটের স্কোরের মতো প্রতিদিন গোটা বিশ্বের আক্রান্ত আর মৃত্যুর আপডেট হচ্ছে৷ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে নাজিম হিকমতের ‘জেলখানার চিঠি' আপনাদের অনেকেরই পড়া৷ তারই একটি লাইন, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর!' করোনা কালে মনে হচ্ছে, তিনি বেঁচে থাকলে লিখতেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের আতঙ্কের আয়ু বড় জোর তিন মাস৷’ ১৮ মার্চ বাংলাদেশে কোভিড-১৯এ প্রথম মৃত্যুর ঘোষণা আসার পর দেশজুড়ে আতঙ্কের যে শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল, তিন মাস পর যেন আতঙ্কটাও সবার গা সওয়া হয়ে গেছে৷ এখন প্রতিদিন ৪০ জন করে মারা যাচ্ছে, তারপরও আমরা সব মানিয়ে নিয়ে চলছি৷ মৃত্যুর পাশেই চলছে জীবনের বিশাল আয়োজন৷ 

বলছিলাম বাংলাদেশে করোনার প্রথম মৃত্যুর কথা৷ মৃত্যুর খবর ১৮ মার্চ হলেও প্রথম সংক্রমণের খবর এসেছিল আট মার্চ৷ এর আগে জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতায় সিঙ্গেল কলামে করোনা ভাইরাসের খবর খুব বেশি কৌতূহলী করেনি আমাদের৷ কিন্তু যখন চীন থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনার থাবা বিস্তৃত হলো, তখন আস্তে আস্তে আমাদের টনকে নড়াচড়া শুরু হয়৷ তখন আবার আশাবাদী বাহিনী মাঠে নামে, বাংলাদেশে যে গরম, তাতে করোনা টিকেব না৷ বাংলাদেশের মানুষের টিকা দেয়া আছে, তাই করোনা এখানে সুবিধা করতে পারবে না৷ থানকুনি পাতা, আদা চা খেয়ে করোনা মোকাবেলার পরামর্শও ছিল কারো কারো৷ আর ধর্মগুরুরা জানিয়ে দেন, করোনা আল্লাহর বাহিনী৷ এটা এসেছে শুধু বিধর্মীদের মারার জন্য৷ আর রাজনীতিবিদরা ঘোষণা করেন, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী৷ করোনা সর্দি-জ্বরের মতো৷ কিন্তু কারো কোনো বাগাড়ম্বরকে পাত্তা না দিয়ে করোনার ভয়াল ঢেউ ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে গ্রাস করে নিয়েছে৷ এখন আমরা বসে বসে ঢেউ গুনছি আর কবে সেই ঢেউ চূড়ায় উঠবে তার দিন গুনছি৷ শেষ আশা হলো, ঢেউ যখন চূড়ায় উঠবে, তখন তা নামবেও৷ উঠলে নামতে হবে, তাই আমরা এখন করোনার চূড়ায় ওঠার অপেক্ষা করছি৷ এমন নিষ্ঠুর অপেক্ষা কে, কবে শুনেছে৷ 

আমরা জানতাম বাংলাদেশে করোনা আসছে৷ তবে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান, করোনা আমাদের দেশে আসতে মোটামুটি আড়াই মাস সময় নিয়েছে৷ গতবছরের ৩১ ডিসেম্বর উহানে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে৷ আর বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয়েছে ৮ মার্চ৷ মাঝের এই অতি মূল্যবান ৬৯টি দিন আমরা নষ্ট করেছি অতি অবহেলায়৷ আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়কে দোষ দেই না৷ আমার ধারণা তারা করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতাটা বুঝতেই পারেননি৷ পারলে তারা এমন নিস্পৃহ থাকতে পারতেন না৷ অবশ্য ৩ মার্চ সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনোভাবে করোনা ভাইরাস চলে এলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই৷ আমরা আগে থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি৷’’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই প্রস্তুতির গল্পের জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-বিএমএ মহাসচিব এবং সরকার সমর্থক ডাক্তারদের নেতা ডাঃ এহতেশামুল হক চৌধুরী৷ এক টক শোতে তিনি বলেছেন, ‘শূন্য প্রস্তুতি নিয়ে আমরা পূর্ণ প্রস্তুতির গল্প শুনিয়েছি৷’ অথচ এই ৬৯ দিনে আমরা অন্য দেশগুলো কীভাবে করোনা মোকাবেলা করছে, মোকাবেলার ক্ষেত্রে কী সমস্যা হচ্ছে; তা জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী নিজেদের তৈরি করে রাখতে পারতাম৷ অথচ আমরা করিনি৷

চীন, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডার মতো দেশকে করোনা যেভাবে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছিল তাতে, বাংলাদেশ যে করোনাকে ঠেকাতে কোনো ম্যাজিক নিয়ে বসে থাকবে; প্রত্যাশাটা মোটেই তেমন ছিল না৷ তবে বাংলাদেশ একেবারে শূন্য প্রস্তুতি নিয়ে করোনা যুদ্ধে নামবে, এটাও প্রত্যাশিত ছিল না৷ আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনা মোকাবেলার চেয়ে করোনা ঠেকানোর চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো৷ আমার মত বিশেষ ভাবে অজ্ঞ সাংবাদিকও এই বাস্তবতটা বুঝেছিলাম৷ কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বোঝেননি কেন? আমি ১০ ফেব্রুয়ারি লিখেছিলাম, ‘‘আমরা চাই, সব ফেলে এখন বিমানবন্দর এবং সব স্থলবন্দরে কঠোর নজরদারি করা হোক, যাতে করোনা ভাইরাস নিয়ে কেউ বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে৷ বাংলাদেশে এলে করোনা আরো অনেক ভয়াবহ হবে৷ কারণ বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ৷ চীনের মত আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারবো না৷ আর যেহেতু ছড়িয়ে পড়ার পর কিছু করার থাকে না, তাই যাতে না ছড়ায় সে চেষ্টা করাই ভালো৷’’ 

চীনে করোনা শনাক্তের পরপরই যদি আমরা বিমানবন্দরে কড়া নজরদারি নিশ্চিত করতে পারতাম, যদি আক্রান্ত দেশের সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখতে পারতাম, যারা আসবেন তাদেরকে বিমানবন্দরে প্রাথমিক পরীক্ষার পর যথাযথ আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন বা চিকিৎসা দিতে পারতাম তাহলে আজ আমাদের পরিস্থিতি হয়তো এত খারাপ নাও হতে পারতো৷ জুতা আবিস্কারের গল্পটা জানা থাকলে আমরা শুধু বিমানবন্দরে লকডাউন আরোপ করতে পারলেই, সারাদেশ তোলপাড় করতে হতো না৷ করোনা ছড়িয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন গ্রামে গ্রামে, ঘুরে ঘুরে প্রবাসী খুজে বেরিয়েছে৷ প্রবাসীদের বাড়ির সামনে লাল পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছে৷ গ্রামে দোকানে রীতিমত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল, এখানে প্রবাসী প্রবেশ নিষেধ৷ যে প্রবাসীদের টাকায় আমাদের অর্থনীতি সচল থাকে, তাদের হঠাৎ ভিলেন বানিয়ে দেয়া হলো৷ প্রবাসে উন্নত পরিবেশে থাকা মানুষদের জন্য একটা মানসম্পন্ন কোয়ারান্টিন সেন্টার বানাতে পারিনি৷ আর প্রবাসীরা কোয়ারান্টিন সেন্টারের পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করায় এমনকি পরররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনও তাদের ‘নবাবজাদা’ বলে গালি দিয়েছেন৷ প্রবাসীদের যেভাবে সবাই মিলে গালাগালি করলাম, তাতে মনে হলো তারা বুঝি কাঁটাতারের বেড়া টপকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন৷ কিন্তু বিষয়টা তো তা নয়৷ তারা তো বিমানবন্দর দিয়ে বৈধভাবেই সবার চোখের সামনে বাংলাদেশে ঢুকেছেন৷ আমি এখনও বিশ্বাস করি, আমরা যদি বিমানবন্দরে করোনার দৈত্যকে বোতলবন্দী করে রাখতে পারতাম, তাহলে আজ সারাদেশে এই দৈত্যের পেছনে দৌড়াতে হতো না৷ আর সবসময়ই বলা হয়, পেছনে দৌড়ে করোনাকে ধরো যাবে না৷ মোকাবেলা করতে হবে সামনে থেকে৷ আমাদের সামনে থেকে করোনা মোকাবেলার সুযোগ ছিল৷ যা আমরা হেলায় হারিয়েছি৷ 

Bangladesch Probhash Amin
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখকছবি: DW/S. Hossain

আরেকটা অন্যায় করেছে আইইডিসিআর৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা শুরু থেকেই করোনা টেস্টের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশ যেন শুরুতে ‘নো টেস্ট, নো করোনা’ নীতি নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল৷ ১৮ কোটি মানুষের দেশে মাত্র দুই হাজার টেস্টিং কিট নিয়ে আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জাতিকে ছেলে ভোলানো গল্প শুনিয়ে গেছেন দিনের পর দিন এবং টেস্ট করার সুবিধাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন৷ তাদের সক্ষমতা হলো হাজারের, দায়িত্ব নিয়ে বসেছিলেন ১৮ কোটি মানুষের৷ এ যেন তিন চাকার বডিতে মার্সিডিজের ইঞ্জিন বসানোর চেষ্টা৷ আর অপচেষ্টায় যা হয়, গাড়ি এখন বসে গেছে৷ বাধ্য হয়ে যখন টেস্টিং সুবিধা ছড়ানো হলো, ততদিনে করোনা ভাইরাসও ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে৷ তবে এখনও করোনা টেস্ট করতে যে হয়রানি, তার কোনো সমাধান হয়নি৷ অনেকে ১০ দিন পরের সিরিয়াল পেয়েছেন৷ ততদিনে করোনা হয় ভালো হয়ে যায়, নয় রোগী আইসিইউতে চলে যায়৷

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অনেক অব্যবস্থাপনা (অনেকে বলছেন ব্যবস্থাপনা থাকলেই না অব্যবস্থাপনার প্রশ্ন) তো ছিলই, আছেও৷ তবে দ্বিধা আর নীতি সমন্বয়হীনতাই করোনা লড়াইয়ে আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে৷ যে ৬৯ দিন অতি মূল্যবান সময় পেয়েছিল বাংলাদেশ, এই সময়টা সঠিক পরিকল্পনা আর দৃঢ় অবস্থানে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে আমাদের সামনে সুযোগ ছিল, করোনা মোকাবেলায় বিশ্বের রোল মডেল হওয়ার৷ কিন্তু হয়েছে উল্টো৷

খালি করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনগুলো ধারাবাহিকভাবে পর্যালোচনা করলেই দ্বিধা আর সমন্বয়হীনতার প্রমাণ মিলবে৷ এমনকি প্রজ্ঞাপন জারি করে দুঃখপ্রকাশসহ তা প্রত্যাহারের মত ঘটনাও ঘটেছে৷ হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা শুরুতে যেমন ঘটেছে, এখনও ঘটছে৷ কিন্তু কোনো ঘটনার জন্য কাউকে সাজা দেয়া হয়নি৷

দূরে থাকা, ঘরে থাকা ছাড়া এখন পর্যন্ত করোনার আর কোনো সমাধান নেই৷ তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউন দিয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে৷ আমাদের সরকারও ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে৷ কিন্তু সাধারণ ছুটি দিয়ে অর্থনীতিকে স্থবির করা হলেও সেই দামে আমরা জীবন কিনতে পারিনি৷ জীবিকা তো গেছেই, জীবনও গেছে৷ সাধারণ ছুটিকে সাধারণ মানুষ 'অসাধারণ ছুটি' হিসেবেই পালন করেছে৷ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ঘোরাফেরা করেছে৷ বাজারে গেছে, জানাযায় গেছে, ঘুরতে গেছে, দলে দলে বাড়ি গেছে৷ কেন সরকার লকডাউন বা কারফিউ বা জরুরি অবস্থা দেয়নি জানি না৷ সরকার মানুষকে ঘরে থাকতে বলেছে বটে, কিন্তু ঘরে থাকতে বাধ্য করেনি৷ ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির পর কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সবকিছু খুলে দেয়া হয়৷ খুলে দেয়ার পর বাসের ভাড়া নির্ধারণ, স্বাস্থ্যবিধি, জোনিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ অথচ এই কাজগুলো হওয়া উচিত ছিল সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে৷ ছুটি শেষ করতে হয় ধাপে ধাপে প্রায়োরিটি ঠিক করে৷ কিন্তু আমরা করলাম উল্টো কাজ৷ প্রথমেই খুলে দিলাম সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প গার্মেন্টস৷ তারপর খুললাম শপিং মল এবং উপাসনালয়৷ অথচ স্বাভাবিক বিবেচনায় যেসব জায়গায় জনসমাগমের শঙ্কা, সেসব খুলতে হয় সবার শেষে৷ সাধারণ ছুটি শেষে হওয়ার ১১ দিন পরে এসে ঢাকার রাজাবাজার এলাকায় পরীক্ষামূলক লকডাউন করা হচ্ছে৷ অথচ সাধারণ ছুটির শুরুর প্রথম ৩০ দিন সারাদেশে বা অন্তত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরে এ ধরনের কঠোর লকডাউন করতে পারলে এখন আমরা অনেক নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম৷ লকডাউন যে কার্যকর তা কিন্তু মিরপুরের টোলারবাগ আর মাদারীপুরের শিবচরে প্রমাণিত হয়েছে৷ তবে এতদিন পর পরীক্ষামূলক লকডাউন কতটা কার্যকর তা নিয়ে আমার সংশয় আছে৷

করোনা যুদ্ধে মূল সেনাপতি হওয়োর কথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর৷ করোনা মোকাবেলায় জাতীয় কমিটিরও প্রধান তিনি৷ তার হাস্যকর ব্যর্থতা পুরো বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে৷ তিনি এখনও স্বাস্থ্যমন্ত্রীই আছেন, তবে নিধিরাম সর্দারের বাস্তব উদাহরণ হয়ে৷ কবে গার্মেন্টস খুলে যায়, কবে যানবাহন চলা শুরু হয় তিনি কিছুই জানেন না৷ জানেন যে না সেই দুঃখ আবার ঘটা করে বলেনও৷ গার্মেন্টস খাত খোলা আর বন্ধ নিয়ে যা হয়েছে, সেটা রীতিমত অপরাধ৷ গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও গার্মেন্টস খোলার ঘোষণা দিয়ে শ্রমিকদের শত শত মাইল হাঁটিয়ে ঢাকায় এনে সমালোচনার মুখে আবার তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত যেন ক্রীতদাস প্রথার আধুনিক ভার্সন৷ দ্বিধা আর সমন্বয়হীনতার আরেকটা উদাহরণ হলো, ঈদে বাড়ি ফেরা৷ প্রথম বলা হলো, ঈদের সময় ৭ দিন কড়াকড়ি খাকবে৷ কেউ চলাচল করতে পারবে না৷ পুলিশ কমিশনার এমনও বললেন, কেউ হেঁটেও বাড়ি যেতে পারবে না৷ এমন হুমকি পুলিশ অনেকবার দিয়েছে৷ কিন্তু ৬৬ দিনের অভিজ্ঞতায় মানুষ জানে, এসবই ফাঁকা আওয়াজ৷ তাই তারা দলে দলে, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিল৷ যেন জীবনে আর বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাবে না৷ সরকার তাদের শাস্তি দেয়ার বদলে উল্টো ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দিল৷ তারপর কার, মাইক্রোবোস, অ্যাম্বুলেন্স যার যা কিছু তাই নিয়ে বাড়ি ফিরলো৷ গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে পিংপং খেলা, শপিং মলে ভিড় আর ঈদে বাড়ি যাওয়ার অবাধ সুযোগের মাশুল আমরা এখন গুনছি প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায়৷ বাংলাদেশের পুলিশ বিরোধী মতকে দমন করে নিষ্ঠুর কায়দায়৷ গুম আর ক্রসফায়ারও এখন গা সওয়া হয়ে গেছে৷ সেই পুলিশ বাহিনী সাধারণ ছুটির সময় মানুষকে ঘরে রাখার ব্যাপারে এত উদার আর মানবিক কেন ছিল? জানি না৷

লেখা লম্বা করে লাভ নেই৷ আরেকটা প্রসঙ্গ বলে শেষ করি৷ ঢাকায় সাংবাদিকদের নানারকম সংগঠন আছে৷ এখন তো প্রত্যেক বিটেরও আলাদা আলাদা সংহঠন আছে৷ কোনো কোনো বিটে একাধিক সংগঠন আছে৷ করোনা সঙ্কটে জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি নানাভাবে সদস্যদের পাশে দাড়িয়েছে৷ তবে সাংবাদিকদের সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ বিজেসি- ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার৷ সম্প্রচার সাংবাদিকদের এই সংগঠন এবারের করোনার সময়ে যেভাবে তার সদস্যদের পাশে দাড়িয়েছে, তা অতুলনীয়৷ একদম শুরুর দিকে বাজার পৌছে দেয়া থেকে শুরু করে সহজে টেস্ট করার সুবিধা, সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ সবকিছুতেই দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ ছিল৷ তবে বিজেসি সবচেয়ে জরুরি যে কাজটি করেছে, তাহলো সদস্যদের কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা৷ নিজের জন্য এখনও নিতে হয়নি৷ তবে অন্যদের জন্য চাইতে গিয়ে দেখেছি সত্যি সত্যি ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেলের মত দ্রুততার সাথে সেবা একদম দোরগোড়ায়৷ হলিফ্যামিলি হাসপাতালের সাথে বিজেসির চুক্তি হয়েছে৷ ৫০টি শয্যা বিজেসি সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত রাখা আছে৷ কেউ অসুস্থ হলে ফোন করার দ্রুততম সময়ে অ্যাম্বুলেন্স বাসায় পৌছে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে৷ কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা নিয়ে যে হাহাকার তৈরি হয়েছিল, তা দেখে নিজের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু বিজেসির উদ্যোগের পর এখন জানি আর যাই হোক, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবো না৷ আমাকে এই নিশ্চিন্তি দেয়ার জন্য বিজেসিকে ধন্যবাদ৷ কিন্তু আমি নীতিগতভাবে এই ব্যবস্থার বিপক্ষে৷ বাংলাদেশে পুলিশের জন্য আলাদা হাসাপাতাল আছে, সেনাবাহিনীর জন্য, বিজিবির জন্যও আলাদা হাসপাতাল, ডাক্তারদেরও চিকিৎসা সুবিধায় অগ্রাধিকার আছে, সম্প্রচার সাংবাদিকরাও নিজেদের জন্য একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে৷ তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে? গত কদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, বাংলাদেশে এখন করোনা রোগীর জন্য বেড পাওয়া কঠিন, কেবিন পাওয়া কঠিনতর আর আইসিইউ পাওয়া অসম্ভব৷ বাংলাদেশে ফাইভ স্টার মানের যে কটি হাসপাতাল আছে, সেগুলো দিনে দুপুরে ডাকাতি করে৷ সাধারণ কেবিনেও দিনে ৭০/৮০ হাজার টাকা বিল করে৷ তারপরও এসব হাসপাতালে ভর্তি হতে অতি উচ্চ সুপারিশ লাগে৷ সাধারণ মানুষের জন্য কে সুপারিশ করবে?

শুরুর দিকে যখন এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস বন্ধ ছিল, কোভিড-১৯এর জন্য কয়েকটি হাসপাতাল নির্ধারিত ছিল; তখন আমি আশাবাদী ছিলাম, এবার বাধ্য হয়েই হয়তো একটা সাম্যবাদী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু হবে৷ আর ভিআইপিরা যদি আমাদের কাতারে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাহলে ব্যবস্থার উন্নতিও হবে৷ কিন্তু আমার সেই সুখ কল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি৷ প্রথমে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালটি ভিআইপিদের জন্য করার পরিকল্পনার কখা বলা হলেও তীব্র সমালোচনার মুখে সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি৷ সম্ভবত সেটি কূটনীতিকদের জন্য রাখা হয়েছে৷ কারণ এত আসন সঙ্কটেও সেটি তৈরি অবস্থায় খালি পড়ে আছে৷ আর অলিখিতভাবে সিএমএইচকে ভিআইপিদের হাসপাতাল বানানো হয়েছে৷ ভিআইপিরা হয় সিএমএইচ নয় কোনো বেসরবারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন; সরকারি হানপাতালের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারেননি৷ এরই মধ্যে আবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু হয়ে গেছে৷ তারমানে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার যে হাল, তাই থাকবে৷ বদলানোর চেষ্টা করারও আর দরকার নেই৷

সব দেখেশুনে যা বুঝছি, শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাড়ানোর মত আর কেউ নেই৷ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা বেহাল আর ভাঙ্গাচোরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে তিনি একাই চেষ্টা করছেন লড়াই করার৷ তার পাশে জনপ্রতিনিধিদের কেউ নেই৷ তবু এ লড়াই আমাদের জিততেই হবে৷ মানুষকে বাঁচাতে হবে৷ খালি ছোট্ট চাওয়া, চিকিৎসায় যেন সবার সমান অধিকার থাকে৷ কে, কী করেন, কোন পেশা, কোন ধর্ম, কোন দল; সেটা যেন বিবেচনা করা না হয়৷ ব্যক্তিটা কে সেটা যেন গুরুত্বপূর্ণ না হয়, সমস্যাটা কী সেটাই হোক বিবেচ্য৷ কার অক্সিজেনন লাগবে, কার আইসিইউ লাগবো; সেটা প্রয়োজন দেখে ঠিক হয়, চেহারা দেখে নয়৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য