চীন সীমান্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ভারতীয় বায়ুসেনা
১৮ জুন ২০২০বায়ু সেনা, নৌ সেনা এবং স্থলবাহিনীকে সবরকম পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বললো নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, ভারত এবং চীনের প্রতিটি সীমান্তেই অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখার খুব কাছে আরও বেশি সেনা নিয়োগ করা হয়েছে। সকলকেই অতি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সূত্র জানাচ্ছে, বায়ুসেনাও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছে। যাতে যে কোনও প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। অন্য দিকে ভারতের নৌসেনা প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে টহল বাড়িয়েছে। তারাও যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
সোমবার রাতে লাদাখের ঘটনার পরে ভারত বা চীন কোনও দেশই সরাসরি যুদ্ধের কথা বলেনি। কিন্তু দুই দেশের বিবৃতিতেই উত্তেজনা পারদ যথেষ্ট চড়া। তারই মধ্যে বুধবার লাদাখে ভারত এবং চীন সেনার ফ্ল্যাগ বৈঠক ভেস্তে গিয়েছে। আজ, বৃহস্পতিবার ফের মেজর জেনারেল স্তরের বৈঠক হওয়ার কথা পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪ তে। এখানেই সোমবার রাতে প্রায় আট ঘণ্টা ধরে ভারত এবং চীনের সৈন্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। যার জেরে ভারতের অন্তত ২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে একজন অফিসার। চীনেরও বেশ কয়েক জন সেনা নিহত হয়েছেন বলে সূত্রের খবর। যদিও সরকারি ভাবে চীন এখনও কিছু জানায়নি।
সোমবার রাতে ঘটনা ঘটার পরে মঙ্গলবারই ঘটনাস্থলে বৈঠকে বসেছিলেন ভারত এবং চীনের অফিসাররা। দুই পক্ষই একে অপরের দিকে আঙুল তোলে। স্থির হয়, বৈঠকে মূলত দু'টি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এর আগে গত শনিবার কোর কম্যান্ডার স্তরের বৈঠকেও এই বিষয়গুলি নিয়েই কথা হয়েছিল। আলোচনার প্রথম বিষয় উত্তেজনা প্রশমন করা। এবং দুই স্থিতাবস্থা রক্ষা করা। স্থিতাবস্থা রক্ষা করার অর্থ, আসল নিয়ন্ত্রণ রেখা মেনে দুই পক্ষই সরে যাবে। অর্থাৎ, বর্তমান অবস্থা থেকে দুই পক্ষকেই পিছু হঠতে হবে। বুধবারের বৈঠকে এ বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারেনি কোনও পক্ষই। বরং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। বৃহস্পতিবার ফের বৈঠকে একই আলোচনা হওয়ার কথা।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এতজন সেনার প্রাণহানি হওয়ার পরে এই মুহূর্তে সীমান্তে উত্তেজনা কমা কঠিন। দুই পক্ষের সেনাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে। ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায়চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''কূটনৈতিক আলোচনার রাস্তা খোলা রাখতেই হবে। কিন্তু সেনার মনোবলের কথাও ভাবতে হবে। ভারতকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আঘাত করা হলে তারা পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দিতে পারে। ২০ জন সেনার প্রাণহানি কম কথা নয়। ভারতীয় সেনা অবশ্যই এর যোগ্য জবাব দেবে।''
সোমবারের ঘটনার পরে বুধবার দুপুর পর্যন্ত কার্যত চুপ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু বুধবার বেলার দিকে তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে সব দিকে ভারসাম্য রাখা হয়েছে। সেনার মৃত্যু ভারত ভুলবে না এবং তার যোগ্য জবাব দেওয়া হবে-- এ কথা যেমন তিনি বলেছেন, আবার এও জানিয়েছেন যে, ভারত শান্তিকামী রাষ্ট্র। আলোচনায় বিশ্বাস করে। প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি শুনে অনেকেই মনে করছিলেন উত্তাপ খানিকটা হলেও কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তারপরেই ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর টেলিফোনে কথা বলেন চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে। বিদেশমন্ত্রকের দাবি, জয়শংকর অত্যন্ত কড়া ভাষায় কথা বলেছেন। বলা হয়েছে, এই ঘটনার জন্য চীনই দায়ী। তারা যদি দ্রুত গোটা ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তার ফল ভুগতে হবে। চীনকে জয়শংকর বলেছেন, সোমবার রাতের ঘটনা ইচ্ছাকৃত ভাবে চীন ঘটিয়েছিল। তারা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।
যে ভাষায় বুধবার দুই দেশের বিদেশমন্ত্রীর কথা হয়েছে, তা এক কথা নজিরবিহীন। বস্তুত ১৯৯০ এর দশকে শেষবার দুই দেশের মধ্যে এত উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছিল। ২০১৭ সালে ডোকলামের ঘটনার পরেও দুই দেশ এত কড়া শব্দ ব্যবহার করেনি।
চীনও বিবৃতি দিয়ে গোটা ঘটনার জন্য ভারতকে দোষী করেছে। চীনের বিদেশমন্ত্রী সে কথা ভারতকে জানিয়েছেন। বলা হয়েছে, সীমান্তে ভারতীয় সেনাকে নিয়ন্ত্রিত রাখার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। চীনের সার্বভৌমত্বে আঘাত লাগলে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তারা তৈরি। প্রকারান্তরে চীনের দাবি, নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে ভারতের সেনা চীনের জমি দখল করে রেখেছে। বস্তুত এ কারণেই সীমান্তে দুই দেশের মেজর জেনারেলদের বৈঠক বার বার ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ দুই দেশেরই অভিযোগ, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা মানছে না দুই দেশের সেনা।
উত্তাপ যে কাটেনি তা স্পষ্ট। তবে বুধবার বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে কূটনৈতিক আলোচনার দরজাও খোলা রাখা হয়েছে। ভারত এবং চীন কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই যাতে সমাধানসূত্রে পৌঁছয়, তার জন্য পৃথিবীর বহু দেশই আর্জি জানিয়েছে। জাতি সংঘও বিবৃতি দিয়ে আলোচনার কথা বলেছে। বুধবার জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেইকো মাসও দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলোচনার রাস্তা খোলা থাকবে। তবে এখনই উত্তাপ কমবে না।