ছিটমহলে নাগরিকত্ব নির্ধারণ
৯ জুলাই ২০১৫বাংলাদেশের চারটি জেলায় ভারতের ছিটমহল আছে৷ লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম এবং নিলফামারী৷ জুলাই মাসের মধ্যে ঐতিহাসিক এই ছিটমহল বিনিময় চূড়ান্ত হলে অবসান হবে ছিটমহলবাসীর কয়েক দশকের কষ্ট আর যন্ত্রণা৷
লালমনিরহাট
লালমনিরহাটে ভারতের ছিটমহল রয়েছে ৫৯টি৷ তারই একটি ছিটমহল বাঁশমারীর বাসিন্দা বিনোদ চন্দ্র ভারতে চলে যেতে চান৷ তিনি এরইমধ্যে জরিপকারী দলের কাছে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে নিজের নাম নিবন্ধন করেছেন৷ টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ‘‘আমি সপরবিারে ভারতের নাগরিত্ব পেতে আগ্রহ জানিয়েছি৷ কারণ আমার আত্মীয়-স্বজনরা সব ভারতে থাকেন৷ তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই৷ তাই সপরিবারে ভারতে যাচ্ছি৷''
তবে ভারতীয় এই ছিটমহলে এমন মানুষও আছেন, যাঁরা বাংলাদেশে থেকে যেতে চান৷ তাঁদেরই একজন শাহজাহান মন্ডল৷ তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশেই আমার সব কিছু৷ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন৷ তাঁদের ছেড়ে আমি কোথায় যাবো?''
লালমনিরহাটের ছিটমহলগুলোতে এ পর্যন্ত ৮৯ জন নারী, পুরুষ ও শিশু ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য ছবি তুলে ফর্মে স্বাক্ষর করেছেন৷ লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার পরিসংখ্যান অফিসার সাইফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এখানে সবাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন৷ নিজেই নিজের নাগরিকত্ব বেছে নিচ্ছেন৷ যাঁরা ভারতে যাবেন, তাঁরা তাঁদের জমি, সহায়সম্পদ বিক্রি করে যেতে পারবেন৷ এমনকি অস্থাবর সম্পত্তি চাইলে সাথে করেও নিয়ে যেতে পারবেন৷''
পঞ্চগড়
পঞ্চগড়ে ভারতের মোট ছিটমহল ৩৬টি৷ দু'দেশের ১০টি সমীক্ষা দল সেখানে কাজ করছে৷ পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন জানায়, ৩৬টি ছিটমহলে ১৮টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে৷ এর মধ্যে পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতটি ছিটমহলে তিনটি, বোদা উপজেলার ২৩টি ছিটমহলে ছয়টি এবং দেবীগঞ্জ উপজেলার ছয়টি ছিটমহলে রয়েছে নয়টি ক্যাম্প৷
পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লায়লা মুনতাজেরি দীনা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘২০১১ সালে ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত একটি যৌথ জরিপ হয়েছিল৷ তখন ঘরে ঘরে গিয়ে লোকগণনা করা হয়৷ এবারের জরিপে আগের সেই জরিপকে ভিত্তি ধরে ক্যাম্প খুলে জরিপ করা হচ্ছে৷ এলাকায় প্রচার চালিয়ে সবাইকে ক্যাম্পে আসতে বলা হচ্ছে এবং ছিটমহলবাসীরা উৎসাহের সঙ্গে ক্যাম্পে আসছেন৷''
তিনি জানান, ‘‘এবারকার জরিপে সাম্প্রতিক সময়ে যে সমস্ত নবজাতক মারা গেছে এবং যারা বৈবাহিক সূত্রে এখানে এসেছেন – তাদের তথ্যও নেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া দুই দেশের জরিপকারীরা প্রত্যেকটি বিষয়ে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন৷''
জানা গেছে, পঞ্চগড়ের ছিটমহল থেকে এ পর্যন্ত ৪৫ জন ভারতে যাওয়ার জন্য নাম তালিকাভুক্ত করছেন৷ পঞ্চগড়ের গাড়াতি ছিটমহলের চেয়ারম্যান মফিদার রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই ছিটমহল থেকে এ পর্যন্ত ১৭টি পরিবার ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে থাকা অথবা ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে ছিটমহলবাসী তাঁদের আত্মীয়-স্বজন কোথায় আছেন এবং ভবিষ্যতের সুযোগ-সুবিধাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন৷''
তাঁর কথায়, ‘‘এই ছিটমহলে বসবাসকারী বিজয় কুমারের তিন ছেলে সপরিবারে ভারতে যেতে চাইলেও, বিজয় কুমার তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে থেকে যাচ্ছেন বাংলাদেশে৷'' সেখানকারই বাসিন্দা মফিদার রহমান বাংলাদেশেই থাকছেন, কারণ তাঁর আত্মীয়-স্বজন সব এই জেলায়ই বসবাস করেন৷''
কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলে এ পর্যন্ত দু'টি পরিবার ভারতে যাওয়ার জন্য নাম নিবন্ধন করেছে৷ কুড়িগামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এজেএম এরশাদ আহসান হাবীব জানান, ‘‘গাও চুলকা-১ এবং কালামাটি ছিটমহলের দুই পরিবারের সাতজন ভারতে যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন৷''
আহসান হাবিব জানান, ‘‘জরিপে ছবি থাকছে৷ থাকছে ১০ ধরণের তথ্য৷ নির্ধারিত ফরমে এই জরিপ কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে৷''
কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি আনিসুর রহমান প্রধান এই আনন্দের মধ্যেও জানিয়েছেন আশঙ্কার কথা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ছিটমহল বিনিময়ের পর ভূমির মালিকানা নির্ধারণ বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে৷ কারণ ১৯১৩ সালের পর আর কোনো ভূমি মালিকানার কাগজ-পত্র নেই৷ অনেকে আবার বৈবাহিক সূত্রে ছিটমহলে এসেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে৷ এখানকার ভূমি মালিকানা অনেকটাই দখলিস্বত্ব৷''
নিলফামারী
নিলফামারীর চারটি ছিটমহলেও যৌথ জরিপের কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলছে বলে ডয়চে ভেলেকে জারিয়েছেন বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের প্রধান মাইনুল হক৷ তিনি জানান, ‘‘ছিটমলগুলোতে এখন আনন্দ আর নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন৷ দীর্ঘ কয়েক যুগের হতাশা আর বঞ্চনার অবসানের আনন্দ এখানে৷''
তবে তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘চারটি ছিটমহলে জরিপের খরচের টাকা নিয়ে নয়-ছয় করছে প্রশাসন৷ বরাদ্দের টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে, তা আমাদের জানানো হচ্ছে না৷''
কোন দেশে যেতে চান আপনি?
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে ১৬২টি ছিটমহলে একযোগে চলছে এই যৌথ জরিপের কাজ৷ ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে ৩৭ হাজার মানুষের বাস৷ অন্যদিকে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা ১৪ হাজার৷
স্থল সীমান্ত চুক্তি ও প্রটোকল অনুযায়ী, ৩১শে জুলাই মধ্যরাতে ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ হয়ে যাবে আর বাংলাদেশের ৫১টি চলে যাবে ভারতের সঙ্গে৷ ছিটমহলবাসীকে তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে৷ ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী, এ সমীক্ষার মাধ্যমে নাগরকিত্ব নির্ধারণ চূড়ান্ত হবে৷ জুলাই মাসের মধ্যে জরিপ শেষ হলেও, আগামী ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত এ নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ পাবে ছিটমহলবাসী৷
প্রসঙ্গত, নাগরিকত্ব নির্ধারণ ও জনগণনা হালনাগাদ ও জটিলতা এড়াতে গত ২২শে জুন থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত ছিটমহলের জমি ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ রাখাসহ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তগুলো বিজ্ঞপ্তি আকারে ছিটমহবাসীকে জানানো হয়েছে৷
গত জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মাদীর ঢাকা সফরের সময় সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে কয়েক দশক ধরে ঝুলে থাকা ছিটমহল বিনিময়ের বাধা দূর হয়৷ এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আগ্রহ এবং উদ্যোগেই ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করে ভারতের সংসদ৷