বিএসএফ, জঙ্গি, হিন্দুত্ববাদী, মন্দিরে হামলাকারীরা কি বুঝবে?
৯ জুলাই ২০১৫আসলে কে আপন? পরই বা কে? বাংলাদেশ, নাকি ভারত? এক সীমান্ত, এক আকাশ, এক মাটি, এক ভাষা- আশাও এক৷ কী আশা? একটু ভালো থাকা – এই তো!
বাংলাদেশে ভারতের যেসব ছিটমহল আছে সেখানকার অনেকে ভারতীয় হতে চান না, আবার ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিটমহলের ১৪ হাজার ২১৫ জনের একজনও চান না বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ‘বাংলাদেশি' হয়ে ফিরতে৷ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ এ নিয়ে অনেক রাজনীতির কথা বলছেন, বলবেন৷ অভিজ্ঞ সাংবাদিক, সমাজবিদ, দার্শনিকরাও নিশ্চয়ই নানাদিক থেকে বিশ্লেষণ করবেন৷ তবে ছিটমহলের মানুষগুলো যে শুধু একটু ভালো থাকার জন্যই নাগরিকত্ব নিচ্ছেন কিংবা নিচ্ছেন না – এ নিয়ে দ্বিমতের কোনো যুক্তি তাঁরাও বোধহয় খুঁজে পাবেন না৷ একটু ভালো থাকতে তো সবাই-ই চায়৷ এ নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ কোথায়?
যে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সুযোগ পেলেই পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারে, যে দেশে ফেলানীর হত্যাকারীকে শাস্তি দেয়া প্রায় ‘যুদ্ধ' হয়ে যায়, হিন্দুত্ববাদ প্রসারের পথ নিষ্কণ্টক করতে যেখানে গরিব মুসলমান-খ্রিষ্টানদের নিয়ে ‘ঘর ওয়াপসি'-র মর্মন্তুদ নাটক হয় – একটু শান্তির হাতছানিও না থাকলে বাংলাদেশে ফেরার সুযোগ পায়ে ঠেলে কেউ সে দেশে থেকে যেতে চায়?
বাংলাদেশের অংশের ভারতীয় ছিটমহলবাসীরাও তো ৬৮টি বছর অপেক্ষার পর মুক্তির আস্বাদ পেলেন৷ ‘না বাংলাদেশ কা, না ভারতকা' – অবস্থা থেকে বের হয়ে সরকারি দলিল-দস্তাবেজেও ভারতীয় হওয়ার সুযোগ হলো৷ এখন কেন ‘স্বদেশ'-এ ফিরছেন না? ‘ভারতীয়' না হলে যে দেশে থাকতে হবে, সে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পেট্রোলবোমায় মানুষ পোড়া, দুর্নীতি, চাপাতির কোপে মানুষ হত্যা, গুম, ফি-বছর সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি মন্দিরে নির্বিবাদে হামলা-অগ্নি সংযোগ, মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ থেকে সংখ্যালঘু মাত্র ১০ শতাংশ হয়ে যাওয়া – এ সব কি জানেন না তাঁরা? নিশ্চয়ই জানেন৷ তাহলে? তাঁরাও কেন ‘বাংলাদেশি' হতে চান?
বিকল্প পথ কুসুমাস্তীর্ণ না হোক সামান্য নিরাপদও যদি না হয়, তাহলে তো মুশকিল৷ সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে৷ সে অবস্থায় মানুষ ঝুঁকি নিতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক৷ ভারত তো শুধু ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ'-ই নয়, বিজেপি-র রামজন্মভূমিও ভারত৷ সে দেশে কোনোদিন সামরিক শাসন আসেনি, তা ঠিক৷ আততায়ীর অতর্কিত হামলায় গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী নিহত হলেও সংবিধানে এমন আঁচড় পড়েনি যাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটির ক্ষতি হতে পারে৷ শব্দ ঠিক আছে, তবে হিন্দুত্ববাদের আস্ফালনে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাটা বড় বেশি ধুঁকছে৷ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা কিছু ‘ভারতীয়' তাই হিসেব কষেই বাংলাদেশিই হতে চায়৷
আবার ভারতের বাংলাদেশি ছিটমহলের সব মানুষই হুড়মুড় করে বাংলাদেশে চলে আসতে চাইবেন, নাগরিকত্ব পাওয়াটাকে সৌভাগ্য মনে করবেন – এমন আশা করাও বোকামি৷ ভারতে সংববিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আছে, আবার বাস্তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও আছে – একদম ঠিক৷ আবার এটাও তো ঠিক, উত্তর প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ইন্ধন যোগানোর অভিযোগটা মোদী মহাশয়ও মুছে ফেলতে পারেন না৷ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও ‘দাঙ্গাবাজ' অপবাদ থেকে রেহাই মেলেনা তাঁরও৷
বাংলাদেশে কয়টা মন্দিরে হামলার পর মামলা হয়েছে? দায়সারাভাবে কোথাও মামলা হলেও সেই মামলার চাকা ঘুরেছে? হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো সরকার কঠোর হয়েছে? বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাইতেই কত বছর লেগে গেল! বিচার করতে গিয়েও কত প্রতিকূলতা, কত কথা! সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার তো চাওয়াই হলো না! রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যার বিচারেরই দাবি নেই, নিশ্চয়তা নেই, সাধারণ মানুষ তো কোন ছার!
বিএসএফ-এর গুলি, জঙ্গির চাপাতির কোপ, হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোল বোমায় মানুষ ঝলসানো, মন্দিরে, বাবরি মসজিদে হামলার ভাষা মানুষকে বড়জোর আতঙ্কের রাজ্যে জিম্মি করতে পারে, কাছে টানতে পারে না৷ ছিটমহলের মানুষগুলো ৬৮ বছরের ‘জিম্মি' জীবন থেকে মুক্ত হয়ে এখন একটু শান্তিতে থাকতে চায়৷ কোন নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট সেই শান্তি দেবে তাঁদের? শান্তি কি আদৌ পাবেন?
সবাই ‘ফুলের ভাষা', শান্তির বার্তা, মানবতার মর্ম বুঝলে ছিটমহল থেকে মুক্ত মানুষগুলো আলবৎ শান্তি পাবেন৷ বিএসএফ, জঙ্গিবাদ, অন্ধ হিন্দুত্ববাদ, পেট্রোল বোমাবাজ, মন্দিরে-বাবরি মসজিদে হামলাবাজরা কি এ সব বুঝবে?