ছোট দলের মহাসংকট
১২ জানুয়ারি ২০২৪তবে সরকারের সঙ্গে জোটে থাকা দলগুলো মনে করে, তাদের সাংগঠনিক শক্তি বেড়েছে, কিন্তু নৈতিক শক্তি হয়ত কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে সরকারবিরোধী শিবিরে থাকা দলগুলো মনে করে, তাদের শক্তি বেড়েছে।
এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাংলাদেশে এখন রাজনীতির দু'টি ধারা। একটি বুর্জোয়া ধারা, আরেকটি সমাজতান্ত্রিক বা বামপন্থি ধারা। এখানে বুর্জোয়া ধারার প্রধান দু'টি দল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি চলছে। সমাজতান্ত্রিক ধারাটি দূর্বল। এতদিন আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত কম বুর্জোয়া ছিল। তারা জনগণের মধ্য থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর বিএনপি ছিল বিত্তবানদের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগও বিত্তবানদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন ক্ষুদ্র দলগুলোকে টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যেতে হয়। যেসব দল এই দুই জোটের বাইরে আছে তারাও কিন্তু বড় দল হয়ে উঠতে পারনি। এই ধারার এক সময় পরিবর্তন হবে। এখন সেই পরিবর্তনে সমাজতান্ত্রিক ধারাও শক্তিশালী হতে পারে অথবা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে ধারা তারাও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।”
গত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ১০টির বেশি রাজনৈতিক দলের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ১৯৯১ সালের পর সিপিবি ও ন্যাপ মোজাফফর দলের পক্ষে থেকে সরাসরি ভোটে কেউ পাস করতে পারেনি। ২৭ বছরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোমের পক্ষ থেকে একাদশ সংসদে প্রথম ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে দুইজন নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে গত ২৮ বছরে সংসদে ঘুরেফিরে ১৪টি দল প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। এর মধ্যে সাত দলের প্রার্থীরা কম-বেশি অধিকাংশ নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আবার কোনোটি এক থেকে দুইবার। কোনটি একবার। বর্তমানে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নামসর্বস্ব দলের সংখ্যা বাড়ছে, যাদের ভোটের রাজনীতিতে কত ভাগ অংশীদারিত্ব তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ১৬টি দল নির্বাচন বর্জন করে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের পর সবচেয়ে বেশি জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে। বিগত সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে ১১টি আসনে। এর বাইরে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পেয়েছে। অর্থাৎ ২৩টি রাজনৈতিক দল থেকে কেউ নির্বাচিত হয়নি।
দীর্ঘ ১৫ বছরে সরকারি দলের সঙ্গে থেকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি কি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে, নাকি দুর্বল হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "খুব সহজে যদি বলি, সাংগঠনিকভাবে আমরা শক্তিশালী হয়েছি। সারাদেশে আমাদের সংগঠন তৈরি হয়েছে। আমরা যদি সংসদে না থাকতাম, তাহলে হয়ত এই কাজটা কঠিন হতো। আবার উল্টোদিকে যদি বলি, সরকারের সঙ্গে থাকার কারণে সরকারের অনেক খারাপ কাজের আমরা সমালোচনা করতে পারিনি। এর ফলে আমাদের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণ করতে পারিনি। এতে হয়ত নৈতিক শক্তি কিছুটা কমেছে।”
সরকারি দলের সঙ্গে জোটে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকারের সঙ্গে থেকে আমাদের দল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির যে ধারা, তাতে বামপন্থি দলগুলোর পক্ষে এককভাবে নির্বাচন করে সংসদে যাওয়া কঠিন। এখন সরকারি দলের সঙ্গে থাকার কারণে সারাদেশে আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে পেরেছি। আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, রব ভাই বা মান্না ভাই চাইলে কালকে কুড়িগ্রামের একটি প্রত্যন্ত এলাকায় সমাবেশ করতে পারবে না। তাদের হয়ত সেখানে সংগঠনই নেই। কিন্তু আমি বা মেনন ভাই চাইলে সেটা করতে পারবো। কারণ, সারাদেশে আমারা সংগঠন তৈরি করতে পেরেছি। এবার হয়ত ভোটে কিছুটা বিপর্যয় হয়েছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের রাজনীতির দু'টি ধারা। একটি পাকিস্তানপন্থি, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। আমাদের আন্দোলনটা ছিল পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধে। সেই আন্দোলনে তো আমরা সফল হয়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি।”
তবে বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন পুরোপুরি উল্টো। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "সরকারের সঙ্গে থেকে ইনু, মেননরা দুর্বল হয়েছে। আর সরকারবিরোধী অবস্থানে থেকে আমরা শক্তিশালী হয়েছি। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, আমার আসনে যদি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেন, তাহলে শেখ হাসিনাও যদি আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তারপরও আমি জিতবো।” এত আত্মবিশ্বাস থাকলে কেন ২০১৮ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "সরকার তো ভয়ে আমার দলকে নিবন্ধন দিচ্ছে না। আজ নিবন্ধন দিক, কালই বলবো আমি আমার দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবো। কিন্তু তারা তো সেটা দিচ্ছে না। ফলে আমাকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে হয়েছে।”
ছোট রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শক্তি না বাড়িয়ে বারবার পড়ছে ভাঙ্গনের মুখে। নেতৃত্বের কোন্দল, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আদর্শিক দলগুলো ভেঙে খান খান। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবেও তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠছে না। সেইসঙ্গে বড় দলগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে সঙ্কীর্ণতা। গত ১৫ বছরে ২০টির বেশি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব দেখা গেলেও কোনোটিই মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। তৃতীয় শক্তিধর রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এখন পাঁচটি ধারায় বিভক্ত, এক সময়ের ন্যাপও এখন পাঁচ ধারায় চলছে। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদেও রয়েছে তিনটি ধারা। গণফোরামও রয়েছে ভাঙনের মুখে। বিকল্পধারা ও এলডিপি, তরিকত ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এ আশঙ্কা থেকে দূরে নেই।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল দীর্ঘদিন ধরে দেশে দ্বিদলীয় রাজনীতি কায়েম করার চেষ্টা করেছে। অনেকাংশে তাদের সেই চেষ্টা সফলও হয়েছে। নীতিহীন দলগুলো এখন বড় দলগুলোতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এটা তাদের নীতিহীন রাজনীতির অনিবার্য ফল। সামনের দিনে অনেক দলই বিলীন হয়ে যাবে। কোনো কোনো দল নামেমাত্র থাকবে। যারা নীতিনিষ্ঠ অবস্থানে থাকবে, তারা যতই ছোট হোক না কেন কখনোই বিলীন হবে না, বরং তারা দিন দিন শক্তিশালী হবে। ছোট দলগুলো, বিশেষ করে যারা বড় দলের সঙ্গে জোটে রয়েছে, তারা এখন অনেক বেশি দুর্বল। তারা যদি সেখান থেকে বের হয়ে এসে নীতির রাজনীতি করেন, মানুষের কথা বলেন, তাহলে তাদের টিকে থাকার সুযোগ আছে।”
স্বাধীনতার পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনসহ মোট ১২ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘুরে ফিরে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ৬ বার, বিএনপি চারবার, জাতীয় পার্টি দু'বার জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ প্রথম, সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে; বিএনপি দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। জাতীয় পার্টি তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়। সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। তবে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ সংসদ মেয়াদকাল পূরণ করে।
তবে ষষ্ঠ সংসদ ছাড়া এখন পর্যন্ত দ্বাদশ সংসদে সবচেয়ে কম দলের প্রতিনিধি সংসদে যাচ্ছেন। এবার আওয়ামী লীগ ছাড়া ৪টি দল নির্বাচনে জিতেছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি ১১টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জিতেছে। স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পর ১৯৯১ সালে গঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদে ১৩টি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এরপর ষষ্ঠ সংসদ বাদে সব সংসদেই প্রতিনিধিত্ব ছিল ছয় থেকে নয়টি দলের। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ৯টি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল।
এবার ভোটে অংশ নিয়ে একটি আসনেও জিততে পারেনি তৃণমূল বিএনপি। তাহলে ভোটে অংশ নিয়ে সাংগঠনিক অবস্থা ভালো হয়েছে নাকি খারাপ হয়েছে? এ প্রসঙ্গে দলটির সভাপতি শমসের মবিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন বাংলাদেশে যে দ্বিদলীয় রাজনীতি চলছে, এক সময় এ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো। জার্মানিতেও তো এক সময় দু'টি দল ছিল। এখন তো আরো অনেক ধারা তৈরি হয়েছে। ভারতেও এক সময় কংগ্রেসের বাইরে কিছু চিন্তা করা যেতো না। এখন সেই কংগ্রেস অস্তিত্ব সংকটে আছে। ফলে বাংলাদেশেও এর পরিবর্তন আসবে। তৃতীয় একটি ধারা এখানে তৈরি হবে। সেটা অল্প দিনে হতে পারে, আবার দীর্ঘ সময়ও লাগতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত যে এই ধারার পরিবর্তন হবে।”