জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ মিলছে গ্রিনল্যান্ডে
১৩ জুলাই ২০২০ইউরোপের এক গবেষকদল একটি প্রাণীর বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে মূল্যবান তথ্য পেশ করছেন৷
বিমানে করে অভিযানের গন্তব্য, অর্থাৎ গ্রিনল্যান্ডের ট্রাইল দ্বীপে কারুপেলভ উপত্যকায় পৌঁছতে এক ঘণ্টা সময় লাগে৷ অথচ ফ্রান্সের জীবতত্ত্ববিদ বনোয়া সিটলার ও জার্মানির ইয়োহানেস লাং এবং তাঁদের সহযাত্রীদের একটা গোটা দিন পথেই কেটে গেছে৷ নীচে গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ ও বরফে ঢাকা ফিয়র্ড দেখা যাচ্ছে৷ ক্ষণস্থায়ী গরমকাল ঠিকমতো শুরু হবার আগেই, অর্থাৎ জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বরফ গলতে শুরু করেছে৷ ছোট্ট রানওয়েতে বিমান নামানোই একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো৷
ময়দা, চিনি, দুধ, কফি, তাঁবু ও অবশ্যই গবেষণার সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়েছে৷ ট্রাইল দ্বীপে কেউ বসবাস করে না৷ তাই বিজ্ঞানীদের একাই সময় কাটাতে হবে৷ সে কারণে কিছু ভুলে গেলে চলবে না৷ কয়েক সপ্তাহ পর ছোট্ট বিমানটি তাঁদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে৷ মাঝের সময়টা তাঁবু দিয়ে তৈরি ক্যাম্পে কাটাতে হবে৷ প্রথমেই সেখানে দুশ্চিন্তার কারণ চোখে পড়েছে৷
বরফের উপর ভালুকের পায়ের ছাপ দেখা গেছে৷ একেবারে কোনো উপায় না থাকলে সেটিকে গুলি করে মারতে হবে৷ আপাতত এক বৈদ্যুতিক বেড়া লাগিয়ে সেটিকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ তবে গোটা প্রকল্পের আসল তারকা মোটেই তেমন বিপজ্জনক নয়৷ ক্যাম্পের কাছেই কলার লেমিং নামের প্রাণীটি ধরা পড়েছে৷
লেমিং নিয়েই প্রায় ৩০ বছর আগে গ্রিনল্যান্ডে বেনোয়া সিটলারের গবেষণা শুরু হয়েছিল৷ তারপর সেটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে পরিণত হয়৷ প্রাণী হিসেবে লেমিং ভোল বা এক ধরনের ইঁদুরের গোত্রে পড়ে৷ উত্তরের এলাকাগুলিতেই এই প্রাণী দেখা যায়৷ গ্রিনল্যান্ডে কলার লেমিং বাস করে৷ শীতে এই প্রাণীর রং বরফের মতোই সাদা হয়, গ্রীষ্মে ধূসর বা বাদামি হয়ে ওঠে৷
উত্তর মেরু অঞ্চলের কম সময়ের গ্রীষ্মকালে লেমিং মাটির নীচে বাসায় থাকে৷ মেরু শিয়াল, বরফের পেঁচা ও শিকারি হক গল পাখির হামলা সম্পর্কে এই প্রাণীকে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হয়৷ শীতকাল সে তুলনায় অনেকটা নিরাপদ৷ তখন লেমিংয়ের সামনের পায়ের নখ বেশ বড় হয়ে ওঠে৷ ফলে জমাট বরফ ও মাটি খুঁড়তে সুবিধা হয়৷ এটাই লেমিংয়ের বংশবৃদ্ধির সময়৷ বরফের পুরু চাদরের নীচে এই প্রাণী সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং শুকনো ঘাস দিয়ে বাসা বাঁধে৷ কখনো একটির উপর আরেকটি বাসাও দেখা যায়৷ তখন একমাত্র নকুলজাতীয় একটি প্রাণী বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে৷ তবে জন্মানোর মাত্র ছয় সপ্তাহ পরই লেমিং শাবক বংশবৃদ্ধি শুরু করতে পারে বলে এই প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যেতে পারে৷
বনোয়া সিটলার লেমিংয়ের শীতকালীন বাসার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন৷ এভাবে তিনি পরোক্ষ উপায়ে গোটা এলাকায় লেমিংয়ের সংখ্যা জানার চেষ্টা করছেন৷ বরফ সরে যাবার ফলে এখন সেই সব বাসা সহজেই চোখে পড়ছে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বরফ আরও আগে গলে যাচ্ছে এবং আরও দেরিতে বরফ পড়া শুরু হচ্ছে৷ ফলে লেমিং-দের বিশাল সংখ্যায় বংশবৃদ্ধির তথাকথিত ‘পিক’ বা সেরা সময় আর দেখা যাচ্ছে না৷ ভালো বছরগুলিতে অভিযান চালিয়ে গবেষকরা এখানে চার হাজারের মতো বাসা দেখেছেন৷ আজকার ৪০০টি বাসা পেলেও মনে হয় পরিস্থিতি ভালো রয়েছে৷ সিটলার বলেন, ‘‘বরফের নীচে লেমিং সম্ভবত সুড়ঙ্গের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল৷ ফলে বাসাগুলির মধ্যেও যোগাযোগ হতো৷ তখন বংশবৃদ্ধিও বেশি হতো৷’’
প্রায় ১৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গবেষণা চালানো হচ্ছে৷ লেমিং-দের সংখ্যা নির্ধারণ করতে গবেষকদের দলকে প্রতি বছর বেশ কয়েকশো কিলোমিটার হাঁটতে হয়৷ দুই সপ্তাহ পর ক্যাম্পের সামনে সমুদ্রের খাঁড়ি থেকে বরফ প্রায় উধাও হয়ে গেছে৷
বেনোয়া সিটলার আবার লেমিংয়ের বাসার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন৷ তবে তিনি এরই মধ্যে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছেন৷ শীতকালে লেমিংয়ের বাসা বিরল হয়ে উঠছে৷ ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য এই প্রাণী সম্ভবত যথেষ্ট বাসা তৈরি করতে পারছে না৷ এই প্রবণতার খুঁটিনাটি বিষয়গুলি সযত্নে নথিভুক্ত করা হচ্ছে৷
ইউরোপের অন্য কোনো গবেষণা প্রকল্পের তথ্যভাণ্ডার সম্ভবত এত বড় নয়৷ ফলে এই গবেষণার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ কিছু মানুষের সংশয় সত্ত্বেও এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষাৎ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে৷
একহার্ড ব্রাউন/এসবি