জলবায়ু শরণার্থী
১২ জানুয়ারি ২০১৩জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের মানুষকেও ভাবিয়ে তুলেছে৷ বালি, বন, কোপেনহেগেন – কোনো সম্মেলনেই সঠিক অর্থে এর প্রতিকার উঠে আসেনি৷ অথচ প্রতিনিয়তই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুত৷ এছাড়া, আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির ফলে মানুষ ‘জলবায়ু শরণার্থী' অথবা ‘পরিবেশ-উদ্বাস্তু বা অভিবাসী'-তে পরিণত হচ্ছে৷ বাধ্য হচ্ছে বাস্তুভিটা ত্যাগ করতে, দেশান্তরী হতে৷
ব্রিটেনের পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান'-এর এক নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী আগামী ৫০ বছরে বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে৷ এর পূর্বাভাষ দেখাও যাচ্ছে কোথাও কোথাও৷ ইতিমধ্যেই পাপুয়া নিউগিনির কার্টিরেট দ্বীপের অধিবাসীদের ‘জলবায়ু শরণার্থী' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ ২০১৫ সালের মধ্যে দ্বীপপুঞ্জটির সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২১০০ সাল নাগাদ যদি এক মিটার সমুদ্রসমতলের পরিবর্তন হয় তাতেই বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন হেক্টর জমি প্লাবিত হতে পারে৷ সম্প্রতি সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি পরিমাপ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে৷ তাছাড়া, ‘‘২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পানির উচ্চতা আরও বাড়বে এবং তার ফলে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুতির পরিমাণ দ্রুততর ও তীব্রতর হবে'', জানান বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থিদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্লাইমেট রেফিউজি' বা এসিআর-এর প্রধান মুহাম্মদ আবু মুসা৷
তিনি জানান, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে৷ আর বাংলাদেশে সংখ্যাটা হবে প্রতি সাতজনে একজন৷ দেশের ১৭ ভাগ এলাকা বিলীন হয়ে যাবে সমুদ্র গর্ভে৷ এই তো এরই মধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ বর্তমানে সারা বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লক্ষ উদ্বাস্তু আছেন বলেও জানিয়েছেন আবু মুসা৷ তার ওপর প্রতিদিনই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকায় এসে বস্তি গড়ছে মানুষ৷ সচ্ছল কৃষকও হয়ে যাচ্ছেন বেকার৷
তাই পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, আগামীতে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে৷ বাধ্য হবে অভিবাসী বা উদ্বাস্তুত হতে৷ কিন্তু এর প্রতিকার কী? মুহাম্মদ আবু মুসার কথায়, ‘‘অনেকেই মনে করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ থেকে বাংলাদেশের বাঁচার একমাত্র পথ অভিবাসন৷ আর সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ যেমন, ভারত বা মিয়ানমারকে এগিয়ে আসতে হবে, খুলে দিতে হবে কাঁটা তারের বেড়া৷ এর জন্য দেশগুলির সুশীল সমাজকে প্রথম পদক্ষেপটি নিতে হবে৷ কিন্তু সেটা বেশ জটিল একটা প্রক্রিয়া৷ তাই আমার মনে হয়, বাংলাদেশের মধ্যেই এর একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে৷''
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও পরিবেশের অন্যান্য ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ একান্তভাবে প্রয়োজন৷ প্রয়োজন পার্বত্য অঞ্চল, যেমন রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছাড়ি বা সিলেটের জমির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার৷ প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধিরও৷ তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলি যদি তাদেরই সৃষ্ট ‘গ্রিনহাউস গ্যাস'-এর নিঃসরণ সময়মতো না কমায়, তাহলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ব্যাপক জীবন ও সম্পদহানি এড়ানো অসম্ভব৷