খুনীদের ন্যায্য বিচার
৭ মার্চ ২০১২১৯৩৪ সালে বগুড়া জেলার দুপচাচিয়া থানার চামরুল গ্রামে জন্ম জাহানারার৷ পিতা আশরাফ উদ্দিন তালুকদার এবং মা তাহেরা খাতুন৷ গ্রামের পরিবেশেই বড় হয়েছেন জাহানারা৷ গ্রামের বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন তিনি৷ এরপরেই ১৯৫১ সালে তাঁর বিয়ে হয় তৎকালীন ছাত্র নেতা এবং আইনজীবী এএইচএম কামরুজ্জামানের সাথে৷ ফলে বিয়ের পর থেকে শ্বশুর বাড়ি রাজশাহীর কাদিরগঞ্জে কেটেছে তাঁর বাকি সময়৷ ছয় সন্তানের জননী জাহানারা কামরুজ্জামান৷ তাঁর এক ছেলে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় সংসদ সদস্য কামরুজ্জামান ঢাকা থেকে আগেই ভারত চলে যান৷ ১৭ই এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিবনগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন কামরুজ্জামান৷ এসময় এক মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে রাজশাহীতে ছিলেন জাহানারা কামরুজ্জামান৷ এরপর তিনি কীভাবে ভারতে পাড়ি জমান সেসব কথা জানালেন জাহানারা৷ তিনি বলেন, ‘‘উনিতো রাজনীতি করে বেড়াতেন৷ ফলে বাড়িতে থাকতেন না৷ তাই আমার উপরেই ছেলে-মেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব পড়ে৷ যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে দুই মেয়ে তাদের বাবার কাছে ঢাকায় গিয়েছিল৷ পরে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তাদের বাবার এক আইনজীবী বন্ধুর সাথে রাজশাহী ফিরে আসে৷ শহরে যখন পাক সেনারা ধর-পাকড় শুরু করে, তখন আমার শ্বশুর আমাদেরকে গ্রামে নিয়ে যান৷ তিনিও রাজনীতি করতেন৷ মুসলিম লীগ থেকে এমএনএ ছিলেন৷ আমার দাদা শ্বশুরও এমএনএ ছিলেন৷ এক কথায়, আমার শ্বশুর বাড়িটা ছিল পুরোপুরি একটি রাজনৈতিক পরিবার৷ ফলে যে গ্রামেই যাই, কয়েকদিন পর দেখি সবাই জেনে যায় আমাদের অবস্থান৷ তখন আবার পাক সেনারা সেই গ্রামে অভিযান চালায়৷ ফলে আমাদেরকে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে৷ আমার স্বামীর সাথে মে মাস পর্যন্ত কোন যোগাযোগ হয়নি৷ জানতাম না যে উনি কোথায় আছেন কিংবা কীভাবে আছেন৷ তবে মে মাসে আমরা ভারত পৌঁছি৷ প্রথমে মুর্শিদাবাদে এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি৷ সেখানে দুই মাস ছিলাম৷ এরপর কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটের একটি বাসায় আমরা গিয়ে উঠলাম৷ একই বাড়িতে চারটি ফ্ল্যাট ছিল৷ সেখানেই তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং আমরা থাকতাম৷''
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বামী-সন্তানদের সাথে দেশে ফিরে আসেন জাহানারা৷ স্বামী কামরুজ্জামান ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৫ সালে নতুন মন্ত্রিসভায় শিল্প মন্ত্রী হন কামরুজ্জামান৷ কিন্তু ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অপর তিন নেতার সাথে এএইচএম কামরুজ্জামানকেও হত্যা করা হয়৷ স্বামী কামরুজ্জামানসহ জাতীয় চার নেতার খুনীদের সুষ্ঠু ও ন্যায্য বিচার চান জাহানারা কামরুজ্জামান৷ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সুষ্ঠু বিচারের অপেক্ষায় আছি৷ কিন্তু এখন আমার বয়স ৭৮ বছর৷ তাই এর সুষ্ঠু বিচার দেখে যেতে পারবো কি না তা জানি না৷ দেখে যেতে পারলে শান্তি পেতাম৷ বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত৷''
২০১০ সালে জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে জাহানারা কামরুজ্জামানসহ ১১ জন বিশিষ্ট নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাহানারা৷ এ ব্যাপারে তাঁর অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমার খুব ভালো লেগেছে৷ আমাকে এমন সম্মান দেওয়ার জন্য আমি গর্ব বোধ করি৷''
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ঝরে পড়ে জাহানারা কামরুজ্জামানের কণ্ঠে৷ তিনি বলেন, ‘‘এতো অরাজকতা, এতো অশান্তি৷ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেল অথচ এখনও খুনাখুনি চলছেই৷ কোন খুনের বিচার হয় না৷ আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা তো কোনদিনই পূরণ হবে না৷ কিন্তু আগামীর প্রজন্ম যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারে৷ এটাই আমার প্রত্যাশা যে দেশে শান্তি হোক৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: রিয়াজুল ইসলাম