1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জামিন হয় না কপাল গুণে...

১৩ আগস্ট ২০২১

লালনের মনের মানুষের সঙ্গে মিলন না হওয়াটা কপাল ‘দোষে' না হয়ে কেন ‘গুণে' হলো, সেটা রবি ঠাকুরের ঘরের ‘তালা'র বদলে ‘চাবি' ভাঙার মতোই দুর্বোধ্য মনে হতে পারে৷

https://p.dw.com/p/3ywgw
Bangladesch | Festnahme | Schauspielerin Porimoni - Produzent Raj
ছবি: bdnews24.com

অন্ত্যমিল বাদ দিলেও ‘উলটো শব্দ' ব্যবহারের ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে, সেটা সাধারণের জানার কথা না৷

ক্ষমতাধরদের চোখের নিমেষে জামিন এবং কারো কারো শতচেষ্টার পরও না হওয়ার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো নিগূঢ় কারণ রয়েছে৷ সেটা আমরা জানি না বা বুঝতে পারি না, এই আর কী!

যেমন ধরুন সিকদার ভাইদের কথাই৷ ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রন ও তার ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া এবং অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে অপহরণ করে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে গত বছর ১৯ মে গুলশান থানায় একটি মামলা হয়৷

২৫ মে সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দুই ভাইয়ের ব্যাংককে পাড়ি জমানোর খবর প্রকাশ হয়৷ সে খবরে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রন হক সিকদারের একটি গাড়ি জব্দ করে৷

মামলায় অভিযোগ, রন হক সিকদার গত বছরের ৭ মে ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডিসহ গুলশানে এক্সিম ব্যাংকে গিয়ে  তাদের প্রস্তাবিত ঋণের টাকার বিপরীতে ‘কো-লেটারেল' হিসেবে সিকদার গ্রুপের রূপগঞ্জ কাঞ্চন প্রস্তাবিত আদি নওয়াব আসকারী জুট মিলটি পরিদর্শনের জন্য নিয়ে যান এমডি হায়দার আলী ও অতিরিক্ত এমডি ফিরোজকে৷ পরিদর্শনের পরে জায়গাটির বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে গ্রাহকের বন্ধকী মূল্যের বিশাল ব্যবধান হওয়ায় এক্সিম ব্যাংকের এমডি ও অতিরিক্ত এমডি দ্বিমত পোষণ করেন৷

এর জের ধরে ‘কৌশলে' এক্সিম ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পূর্বাচলে নিয়ে ‘হত্যার উদ্দেশে গুলিবর্ষণ' এবং অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সেখান থেকে বনানী ১১ নম্বরে সিকদার হাউজে নিয়ে ‘হেনস্থা করা হয়' বলে অভিযোগ করা হয়েছে এজাহারে৷ এজাহারে বলা হয়, জমির দাম কম বলায় রন ও দীপু এক্সিম ব্যাংকের এএমডি ফিরোজকে ‘মারতে উদ্যত হলে' তিনি মাফ চেয়ে প্রাণে বাঁচেন৷

‘‘রন হক সিকদার ও দিপু সিকদার (এক্সিম ব্যাংকের) এমডিকে প্রজেক্টের সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী আছে দাবি করে তাদের সাথে থাকা অস্ত্র তাক করে জোরপূর্বক একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়৷'' এক্সিম ব্যাংকের এমডি, এএমডি ও দুই চালককে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অস্ত্রের মুখে জিম্মি রেখে পরে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়৷

এরপর কী ঘটে মনে আছে? সিকদার ভাইদের বাবা সিকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান৷ এরপর ১২ তারিখ দেশে ফেরেন রন হক সিকদার৷ তাকে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পলাতক আসামি হিসাবে গ্রেপ্তার হওয়া সত্ত্বেও বাবার মৃত্যুর ঘটনায় ‘মানবিক দিক' বিবেচনায় কয়েক ঘণ্টা পর তিনি জামিন পান৷ পুলিশ কোনো রিমান্ডেরও আবেদন করেনি৷

এরপর ১০ আগস্ট এই হত্যাচেষ্টা মামলায় দুই সিকদারের অব্যাহতি চেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে ডিবি পুলিশ৷ পুলিশের মন্তব্য, যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই মামলা, সেটি ছিল দুই পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, যার নিরসন হয়েছে৷ ১২ আগস্ট আদালত মামলা থেকে তাদের অব্যাহতিও দিয়ে দিলেন৷

ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে৷ সেটা তদন্তকারী কর্মকর্তারাই ভালো বুঝবেন৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ‘গুলি করে হত্যাচেষ্টা' ঘটনাটি ঘটলো সেটি কে ঘটালো? যদি এটি মিথ্যা অভিযোগ হয়ে থাকে, তাহলে কি জনগণের অর্থ ও আদালতের সময় অপচয়ের জন্য মিথ্যা মামলার দায়ে উলটো এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হওয়ার কথা না? যদি অন্য কেউ এই গুলির ঘটনা ঘটিয়ে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও মামলা হওয়া উচিত৷ কিন্তু এত গুরুতর অভিযোগটি তো  হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না, তাই না?

অথচ, ঝুমন দাস নামের এক গ্রামের ছেলে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে ১৬ মার্চ থেকে এখনও কারাগারে৷ সাত বার জামিনের আবেদন করেও তার সে আবেদন নাকচ হয়েছে৷ আর সেই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের গ্রামে হামলা চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার ৫২ জনের সবাই এখন মুক্ত৷

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলে
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

ঝুমন স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে৷ সেই মামুনুল হকও এখন কারাগারে৷ তার বিরুদ্ধে অনেকের নানা রকম অভিযোগই রয়েছে৷ ধর্মীয় সহিংসতার উসকানি, ভাস্কর্য ভাঙচুরের উসকানি ইত্যাদি নানা রকম অভিযোগ অনেকেই করেছেন৷ সেসবের নানা প্রমাণও তারা হাজির করেছেন৷ কিন্তু হেফাজতের নেতা হওয়ায় ‘গ্রেপ্তার করলে আগুন জ্বলবে' টাইপের হুঙ্কারও শোনা গেছে অনেকের মুখে৷ এমন ‘ঝামেলা’ এড়াতেই কিনা কে জানে, তাকে জড়ানো হলো ‘নারী' সংক্রান্ত মামলায়৷ এবং এখনও তিনি কারাগারে৷ মামুনুলের সঙ্গে থাকা নারীই তার বিরুদ্ধে কয়েকদিন পর করলেন ধর্ষণ মামলা৷

একই ঘটনা নায়িকা ও মডেল পরীমনির ক্ষেত্রেও ঘটলো৷ তার বাসায় মদ পাওয়া গেলো, একের পর এক ভিডিও ফাঁস হতে লাগলো, পরম আগ্রহ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোও নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সেগুলো প্রকাশ শুরু করলো৷ সেই পরীমনিরও জামিন তো হলোই না, বরং উলটো একাধিকবার রিমান্ডে যেতে হলো

এ তো গেল জামিন না হওয়ার কথা৷ আবার আসি জামিন হওয়া প্রসঙ্গে৷ ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫২ জনের মৃত্যুর কথা মনে আছে? ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেম, তার চার ছেলেসহ আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে। ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ হাসেম ফুডস কারখানার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হাসেম এবং দুই ছেলে হাসিব বিনতে হাসেম ও তারেক ইব্রাহিমকে জামিন দেন৷

জামিন পেলে অভিযুক্ত পালিয়ে যাবে না, বা বাদী ও সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখাবে না, এই দুই শর্তই এইসব মামলায় যথেষ্ট হওয়ার কথা৷ এই ব্যপারগুলো পরীমনি বা ঝুমন দাসের মতো মানুষদের চেয়ে প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিদেরই ক্ষেত্রেই বেশি দেখার কথা৷ অথচ বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি উলটোটা৷

ব্যাপারটা লালনের গানটার মতোই গোলমেলে৷ শশী তো আলোকিত এবং ঝকঝকে চকচকে হওয়ার কথা৷ তার বদলে চাতক কেন অহর্নিশি কালো শশীর দিকে চেয়ে থাকে, তা লালনই ভালো বলতে পারবেন৷ নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো নিগূঢ় কারণ রয়েছে৷ সেটা আমরা জানি না বা বুঝতে পারি না, এই আর কী!