জামিনে অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার পরোক্ষ ‘প্রভাব'
১৩ আগস্ট ২০২১সিকদার গ্রুপের দুই ভাইয়ের কথাই ধরা যাক৷ রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হওয়ার পরও চার্টার্ড বিমানে করে থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান গত বছরের এপ্রিলে৷ সেখান থেকেই তারা হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চে জামিনের আবেদন করলে আদালত তাদের জামিন না দিয়ে জরিমানা করেন এবং তাদের আইনজীবীকে ভর্ৎসনা করেন৷
কিন্তু গত ১২ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরার পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই রন হক সিকদার জামিন পান৷ জামিন নিতে তাকে আদালতেও যেতে হয়নি৷ তার বাবা সিকদার গ্রুপের মালিক জয়নুল হক সিকদার মারা যাওয়ায় সেদিন সকালে দেশে ফিরলে বিমানবন্দরেই তাকে আটক করা হয়৷ এরপর তাকে আদালতে হাজির না করে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন মঞ্জুর করা হয়৷ মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তার জামিনের বিরোধিতা করা হয়েছিল৷ হত্যাচেষ্টার এই মামলাটি জামিন অযোগ্য মামলা৷
অভিনেত্রী পরীমনির দায়ের করা ধর্ষণচেষ্টার মামলায়ও সহজেই জামিন পেয়েছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ৷ অন্যদিকে পরীমনি এখন অন্য মামলায় দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে আছেন৷ আবার সুনামগঞ্জের শাল্লার ঝুমন দাস গত পাঁচ মাসে জামিন না পেলেও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার অভিযোগে যারা আটক হয়েছিলেন তাদের সবাই জামিন পেয়েছেন৷
বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে মুনিয়ার আত্মহত্যায় প্ররোচনার যে মামলাটি, সেটিও কিন্তু জামিন অযোগ্য৷ কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ তিনি আদালতে আত্মসমর্পণও করেননি৷ জামিনের প্রসঙ্গ তো পরে৷ তবে এই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য পুলিশ আদালতে আবেদন করেছে৷
বাংলাদেশে এরকম অনেক উদাহরণ আছে যে একই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরও কেউ জামিন পান আবার কেউ পান না৷ কেউ বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাগারে আটক থাকেন আবার কেউ জামিনে ছাড়া পেয়ে বাদীকে উল্টো হয়ারানি করেন, হুমকি দেন৷
আইনজীবীদের সথে কথা বলে জানা গেছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা আছে কোন মামলায় জামিন দেয়া যাবে আর কোন মামলায় দেয়া যাবে না৷ আবার অপরাধেরও দুটি ধরন আছে৷ ধর্তব্য এবং অধর্তব্য অপরাধ৷ সাধারণভাবে অধর্তব্য অপরাধ জামিনযোগ্য৷ এগুলো লঘু অপরাধ৷ তবে ধর্তব্য অপরাধ হলো ‘গুরু' বা বড় অপরাধ এবং সেগুলো জামিন-অযোগ্য৷ যেমন: হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক মামলা ইত্যাদি৷ আর নারী, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের জন্য জামিনের বিশেষ বিবেচনা আছে৷
তবে মামলার এজাহার বা পারিপার্শ্বিক আরো অনেক বিবেচনায় জামিন অযোগ্য মামলায়ও আসামিরা জামিন পেয়ে যান৷ আদালত যদি স্বীয় বিবেচনায় মনে করেন জামিন দিলে মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে না, তাহলে জামিন দিতে পারেন৷ আবার জামিনের শর্ত ভঙ্গ করলে তা বাতিলও করতে পারেন৷ আর নিম্ন আদালত জামিন না দিলে উচ্চ আদালতে যাওয়া যায়, ‘যথার্থ' কারণ থাকলে সরাসরি হাইকোর্টেও জামিন চাওয়া যায়৷
এসব হলো আইনের কথা৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কী? সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘এখানে আইন আসলে অন্ধ নয়, আইনের চোখ আছে৷ সে কারণেই প্রভাবশালীরা জামিন পায়৷ চোখ আছে বলেই এত বড় ঘটনার পরও সিকদার গ্রুপের লোকজন পলাতক অবস্থায় এয়ারপোর্টে নামার পরই জামিন পেয়ে যায়৷”
মামলার দুর্বলতা, পুলিশর ইচ্ছা- এসবের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে বলে তিনি মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যাকে আটকাতে চায় তার বিরুদ্ধে আদালতের রিমান্ড ফরোয়ার্ডিং-এ বিশাল বিশাল অপরাধের আশঙ্কার কথা লিখে দেয়, আর যাকে ছাড়তে চায় তার ব্যাপারে তেমন কিছু লেখে না৷ এমনকি অনেক সময় জামিনের বিরোধিতাও করে না৷ অতীতে জামিনের বিরোধিতা না করার কারণেও অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিন পেয়েছে৷ আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হলে জামিন না দেয়ার জন্য সবাই একযোগে কাজ করেন৷”
অনেক সময় আইনজীবীর ওপরও জামিন নির্ভর করে৷ অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন আদালত না দিলেও উচ্চ আদালত জামিন দেয়৷ ‘বড় আইনজীবী' দাঁড়ালে জামিন পাওয়া যায়৷ এমন আইনজীবী পাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই আর্থিক সক্ষমতা একটা বড় বিষয়৷ আইনজীবী তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘‘অভিজ্ঞ আইনজীবী আইনের বিষয়গুলো ভালো বোঝেন৷ তিনি জামিনের প্রেক্ষাপট ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন৷ এজাহারের কোন জায়গায় জামিনের সুযোগ আছে, তা ধরতে পারেন৷ স্বাভাবিক কারণেই তাদের ফি বেশি৷ আর একাধিক আদালতে গেলে তো খরচ বাড়বেই৷”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বিষয়টিকে দেখেন রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের দায়ের দিক থেকে৷ তিনি বলেন, ‘‘একই ধরনের অপরাধে আটক হয়ে একজন জামিন পান, আরেকজন পান না৷ শুধু তাই নয়, কেউ কেউ জামিন নেয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না, মামলা থাকার পরও প্রকাশ্যে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেন৷ সম্প্রতি আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় একজন প্রভাবশালীর ক্ষেত্রে আমরা এরকম হতে দেখেছি৷ আবার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার পরও গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপপ্রচারও চালায়৷ এটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অগণতান্ত্রিক মনোভাব ও বিচারবিভাগের দুর্বলতার কারণে হয়৷”
তিনি মনে করেন, ‘‘অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার কাছে আইন সঠিকভাবে কাজ করে না, গতি হারিয়ে ফেলে৷”