‘আউটোবান’
১০ আগস্ট ২০১২হিটলারের প্রচারণার হাতিয়ার
বালির স্তূপে কোদাল গুঁজে স্বয়ং হিটলার দাঁড়িয়ে৷ গা ঘেঁষে সৈন্যদের দল৷ একজন ক্যামেরা হাতে মুগ্ধ হয়ে ‘ডেয়ার ফ্যুয়রার' বা সর্বোচ্চ নেতার ছবি তুলছে৷ চলছে ‘আউটোবান' বা জার্মানির বিখ্যাত হাইওয়ে তৈরির তোড়জোড়৷ নাৎসি আমলে এমন ছবি গোটা জার্মানিতে ছড়িয়ে দেওয়া হতো৷ প্রচারণার বিশাল হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই হাইওয়ে নির্মাণ প্রকল্প৷ বেশ নাটকীয়ভাবে প্রস্তুত করা হতো ছবির প্রেক্ষাপট৷ হাইওয়ে উদ্বোধনের সময় আবার নতুন ছবি৷ কাজ শেষ, সফল প্রয়াস৷
অথচ শুরুতে নাৎসিরা কিন্তু এই উদ্যোগের ঘোরতর বিরোধী ছিল৷ শুরু থেকেই জার্মানির ‘আউটোবান'এর বৈশিষ্ট্যই হলো, এই পথে শুধু গাড়ি বা অন্যান্য মোটর যান চলাচল করবে৷ পথচারীদের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে থাকবে হাইওয়ে৷ তাছাড়া পথে কোনো বাধা থাকবে না৷ গতিপথ হবে শহরের পাশ দিয়ে৷ প্রয়োজনে যে কোনো গাড়ি হাইওয়ে ছেড়ে আলাদা পথের মাধ্যমে কোনো শহরে প্রবেশ করবে অথবা শহর থেকে হাইওয়েতে প্রবেশ করবে৷
নাৎসি'রা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে একযোগে এই পরিকল্পনা বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল৷ তাদের যুক্তি ছিল, এমন পথ তৈরি হলে শুধু ধনী, অভিজাত শ্রেণি এবং ইহুদি পুঁজিবাদীদের স্বার্থসিদ্ধি হবে৷ জনগণের কোনো কাজে আসবে না৷ এই প্রকল্পের অর্থায়ন সংক্রান্ত আলোচনাও বর্জন করেছিল নাৎসিরা৷ ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য নাৎসিরা রাতারাতি তাদের অবস্থান বদলে ফেলে এই প্রকল্প থেকে ফায়দা তোলার চেষ্টা শুরু করে৷
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
অর্থনৈতিক সংকট ও মূলধনের অভাবে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে আউটোবান নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি৷ চরম বেকারত্ব, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণের কারণে জার্মানির তখন করুণ অবস্থা৷ তখন কোলোন শহরের মেয়র ছিলেন কনরাড আডেনাউয়ার, যিনি পরে ফেডারেল জার্মানির প্রথম চ্যান্সেলর হয়েছিলেন৷ তিনিই কোলোন ও বন শহরের মধ্যে জার্মানির প্রথম আউটোবান নির্মাণ ও তার অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন৷ আজ সেই আউটোবান'এর নাম ‘এ ৫৫৫'৷
সেসময়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই হাইওয়েতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানোর নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়, যদিও সে আমলের বেশিরভাগ গাড়ির ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের চেয়ে দ্রুত চলার ক্ষমতা ছিল না৷ গোটা দেশের মধ্যে কোলোন শহরের আশেপাশেই সবচেয়ে বেশি গাড়ি চলতো৷ নাৎসিরা ক্ষমতায় এসে চালাকি করে ‘আউটোবান' হিসেবে সেই পথের মর্যাদা কেড়ে নেয়৷ প্রথম হাইওয়ে তৈরির কৃতিত্ব নিতে পরে ঘটা করে আবার নতুন করে সেই একই পথকে আউটোবান হিসেবে ঘোষণা করে তারা৷
স্বপ্নের সূচনা
জার্মান আউটোবান'এর এই স্বপ্ন কিন্তু আরও আগে দেখতে শুরু করেছিলেন শিল্পপতি ও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা৷ সেটা ছিল ১৯০৯ সাল৷ তারা তখন মোটরগাড়ির জন্য এমন আলাদা পথের জন্য দরবার শুরু করেন৷ সেই পথে ধুলোবালি থাকবে না, থাকবে না ঘোড়ার গাড়ি বা পথচারীরা৷ যেমন কথা, তেমনি কাজ৷ ১৯১৩ সালে বার্লিনের উপকণ্ঠে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এমন এক পরীক্ষামূলক রাস্তা তৈরি করার কাজ শুরু হয়৷ তবে শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবের কারণে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ তৈরি হয়৷
তারপর এল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ৷ ফলে কাজ বন্ধ হয়ে গেল৷ ১৯২১ সালের পর সেই পথকে শুধু দ্রুতগামী স্পোর্টস কার পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হতো৷ সাধারণ গাড়ির জন্য এই পথ আর খোলা হয় নি৷ ১৯২৬ সালে একটি সমিতি জার্মানির মধ্য দিয়ে হামবুর্গ, ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে সুইজারল্যান্ড'এর বাসেল শহর পর্যন্ত একটি মোটারগাড়ির পথ তৈরি করার উদ্যোগ শুরু করলো৷ নাৎসিরা অবশ্য সেই প্রকল্প বানচাল করে দেয়৷ তবে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর পরিকল্পিত এই দীর্ঘ পথের অংশবিশেষ তৈরির কাজ শুরু হয়৷
হিটলারের চাল
ইহুদি নিধন যজ্ঞের হোতা হিটলারও কিছু ভালো কাজ করেছিলেন বলে যে প্রচারণা চালানো হয়, তা যে কতটা ভুল, ঐতিহাসিকরা তা মনে করিয়ে দেন৷ হিটলার ‘মোবিলিটি' বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার জন্য দ্রুত গতির পথের খোঁজ করতেন বলে যে ধারণা চালু আছে, তা আসলে ঠিক নয়৷ তবে দেশের মানুষের মন ভোলাতে ও নিজের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নিতে তিনি এক মন-ভোলানো অর্থহীন প্রকল্পের উপযোগিতার কথা বুঝতে পেরেছিলেন৷
সে সময়ে জার্মানির হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের হাতে গাড়ি কেনা বা রাখার ক্ষমতা ছিল৷ ফলে নতুন আউটোবান ব্যবহারের সামর্থ্যও তাদের ছিল না৷ কিন্তু নাৎসিদের প্রচারণা যন্ত্র ‘মোবিলিটি'র হুজুগ তোলার চেষ্টা করেছিল৷ তাদের স্লোগান ছিল, শুধু বড়লোক নয়, সব মানুষই ভ্রমণ করতে পারবে৷ হিটলারের চাপে প্রথম হাইওয়েগুলিতে বাস পরিষেবাও চালু করা হয়েছিল৷ প্রতি বছর ১,০০০ কিলোমিটার আউটোবান তৈরি করতে হবে, এটাই ছিল হিটলার'এর নির্দেশ৷ এর মাধ্যমে বেকারত্বের সমস্যারও সমাধান করার চেষ্টা ছিল হিটলারের মনে৷
প্রায় ৬ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষকে কাজ দেওয়া হয়েছিল৷ তাদের কাজের পরিবেশ ছিল কঠিন৷ অনেকেই সেই ধকল সহ্য করতে পারে নি৷ ধর্মঘট করলে সোজা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তবে সেই অপ্রিয় খবর প্রকাশ্যে জানানো হয় নি৷ এমনকি কাজ না হওয়া সত্ত্বেও প্রচারণার তাগিদে মানুষজনকে শ্রমিক সাজিয়ে তাদের ছবি তোলা হয়েছে৷
প্রতিবেদন: ডিক ডাব্লু, লিশটেনব্যার্গ এ / এসবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ