শিশু দত্তক নেওয়ার প্রবণতা
৩০ জুলাই ২০১৩১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সৌলে জন্ম কিম-এর৷ তবে ঠিক পরের গ্রীষ্মেই মাত্র ছয় মাস বয়সে এক জার্মান দম্পতি কিমকে পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন৷
রপ্তানি পণ্য হিসেবে শিশু
কিম স্পেরলিং ২৮২৯ শিশুর একজন, যাদের ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে জার্মানিতে আনা হয়৷ শিশু সাহায্য সংস্থা ‘ট্যার দে সম্' এসব শিশুকে জার্মান দম্পতিদের কাছে হস্তান্তর করে৷ এদের মধ্যে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া থেকেই আনা হয় ১৮৯৮টি বাচ্চা৷ উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে শিশুদের দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে যেসব সংস্থা এগিয়ে এসেছে, তার মধ্যে ‘ট্যার দে সম্'-ই প্রথম৷ ইতিমধ্যে সফল কর্মকাণ্ডের জন্য অ্যাডপশন এজেন্সি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পেয়েছে সংগঠনটি৷
শুরুতে সংস্থাটি বিশেষ করে ভিয়েতনামি শিশুদের জার্মানিতে আনার ব্যবস্থা করতো৷ তবে ৭০-এর দশক থেকে তাদের নজর পড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে৷ ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার শিশুকে বিদেশে পাঠানো হয়৷ এসব শিশুর অনেকে এতিম৷ আবার অনেকের জন্ম হয়েছে যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদের ঔরসে৷ এই সব শিশুর জন্ম বৈধ নয় এবং তাদের শরীরে রয়েছে ‘বিদেশি রক্ত'৷ এমনটি মনে করা হয় কনফুসিয়ান আদর্শে বিশ্বাসী কোরিয়ান সমাজে৷
এছাড়া ৬০-এর দশকে দেশটিতে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ ‘ট্যার দে সম্'-এর মুখপাত্র মিশায়েল হয়ের জানান, ‘‘এইসময় মানুষ নগরমুখী হতে শুরু করে৷ এদের মধ্যে ছিল অনেক তরুণী, যারা কারখানাগুলোতে কাজ করত৷ সেখানে তারা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভবতী হলে তাদের বাচ্চাদের বাইরের দেশে পোষ্য হিসেবে লালন-পালনের জন্য দিয়ে দিতো৷
উপযুক্ত পিতা-মাতার সন্ধান
এই কাজটিই এসে পড়ে ‘ট্যার দে সম্'-এর হাতে৷ প্রথমদিকে বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত পিতামাতা ঠিক করার ব্যাপার তেমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম কানুন ছিল না৷ মিশায়েল হয়ের বলেন, ‘‘আসলে তখন বিদেশ থেকে পোষ্য গ্রহণের বিযয়টি ছিল একটি নতুন ঘটনা৷'' শুরুতে মনে করা হয়েছিল, যে যেসব বাচ্চার জন্য মা-বাবা প্রয়োজন, তাদেরকে দত্তক নিতে আগ্রহী দম্পতি পেলেই যথেষ্ট৷ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সংস্থাটি লক্ষ্য করে যে, এতে অসুবিধা হচ্ছে৷ তাই সম্ভাব্য পালক পিতা-মাতার সন্ধানে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া তৈরি করা হয়৷ এর মধ্যে রয়েছে যুব দপ্তর ও মনোবিজ্ঞানীদের সাথে আলাপ আলোচনা করে উপযুক্ত মাবাবা ঠিক করা৷ সবশেষে একটি পরিষদের মাধ্যমে প্রার্থীর যোগ্যতার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা৷
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
অন্যদিকে আর একটি সমস্যা হলো কোরিয়ার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা৷ যেমন দত্তক নেওয়ার জন্য কোনো শিশুকে পছন্দ করা হলে অনাথ আশ্রমগুলিকে বেশ কসরত করতে হয়৷ জন্মসনদ পেতে আদালত কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ঘোরাঘুরি করতে হয় বহুবার৷ এছাড়া দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়া কোরিয়ার আইন মেনে হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য সেখানকার আইনজীবীদের ছাড়পত্র লাগে৷ এসব পদক্ষেপ যথাযথভাবে সম্পন্ন হলেই কোনো শিশুকে পালক নেওয়া সম্ভব৷
শিশু জার্মানিতে পৌঁছানোর পর থেকে পালক পরিবারকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে টেরে ডেস হোমেস৷ সংস্থাটির মুখপাত্র মিশায়েল হয়ের জানান, ‘‘প্রথমদিকে আমাদের কর্মীরা এবং পালক পিতামাতারা মনে করতেন, শিশুটি তো জার্মানিতে চলে এসেছে, সে এখানে বড় হলে জার্মান সমাজের সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে পারবে৷'' কিন্তু পরবর্তীতে বিশেষ করে ৮০-র দশক থেকে স্পষ্ট হয় যে, এই হিসাবটা আসলে মিলছে না৷ প্রতিনিয়তই সংস্থাটি নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে৷
আসল পরিচয়ের সন্ধান
‘‘যৌবনে পৌঁছে পালিত সন্তানরা জানতে চায়, আসলে আমি কোথা থেকে এসেছি? আমাকে কেন এখানে পাঠানো হয়েছিল? আমার আসল বাবা-মা কোথায়?'' তরুণদের এসব প্রশ্নের উত্তর জানার সুযোগ দিতে চেষ্টা করে ‘ট্যার দে সম্'৷ ১৯৯০ সালে প্রথম এই সব তরুণ-তরুণীকে জন্মভূমির সঙ্গে পরিচয় করাতে দক্ষিণ কোরিয়ায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করে সংস্থাটি৷ সেই থেকে এই ধরণের ভ্রমণের আয়োজন অব্যাহত রয়েছে৷
কিম স্পেরলিং জন্মভূমির সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই নাড়ির টান অনুভব করেন দেশটির জন্য৷ নিজের আসল মায়ের খোঁজ পেতে অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি৷ শিক্ষা ও পেশাগত কাজ নিয়ে বারবার ফিরে গেছেন প্রিয় জন্মভূমির বুকে৷ তবে মায়ের খোঁজ পাওয়ার সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়৷
কিম কি জার্মান, নাকি কোরিয়ান? এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর তাঁর নিজেরও জানা নেই৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘নানা দিক দিয়ে আমি আসলে একজন কোরিয়ান৷ কিংবা হয়ত বা কোরিয়ান-জার্মান দুটোই৷'' স্ত্রী কোরিয়ান হওয়াতে দৈনন্দিন জীবনের সব কর্মকাণ্ডই দুই জগতের মাঝে আবর্তিত হয় কিমের৷ তাই তো তিনি বলেন, ‘‘কোরিয়া আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে৷ ভালোই তো৷''