জাহাজ ভাঙা শিল্প: সমস্যা প্রকট
১৮ এপ্রিল ২০১৭শাসকদের অসীম ক্ষমতা৷ ন্যায়ের চেয়ে অন্যায় কাজ করায় পারদর্শী৷ ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, জনমানুষের ভয়ংকর ক্ষতি বা বিপদ থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তাদের সীমাহীন দুর্বলতা৷ এ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা বোঝাতে চান ‘ক্ষমতা নেই' ইচ্ছে ছিল৷ ফলে কাজটি আমরা করতে পারছি না৷
এমন অনেক ক্ষত বা ঘটনা নিয়ে কথা বলা যায়৷ তবে সবগুলো নিয়ে নয়৷ আজকের বিষয় বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প৷ এই শিল্পের সামগ্রিক বিষয় খুব বেশি মানুষ জানেন না৷ এর একটি বড় অর্থনৈতিক দিক আছে৷ আছে তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি কুফল৷ এসবের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্কে অধিকাংশ সময়, সরকার দর্শক৷ তার যা করা দরকার করে না৷ এই করব, সেই করব, করতে চেয়েছিলাম, বিরোধিতার কারণে করা গেল না, ইত্যাদি কথা বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে৷ করা হয় না কিছু৷ আর দশটি সেক্টরের মতো জাহাজ ভাঙা শিল্পও চলছে সরকারি অভিভাবকত্বহীনভাবে৷ পরিবেশ আর জনমানুষের নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে বলা হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প চলতে দেয়া উচিত নয়৷ আবার অর্থনৈতিক বিবেচনায় যুক্তি দেয়া হয়, জাহাজ ভাঙা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে, দিতে হবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা৷
এই পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্ককে সামনে রেখে সংক্ষিপ্ত আলোচনা
১৷ জাহাজ ভাঙার ইতিহাসটা কম-বেশি অনেকে জানেন৷ বিস্তারিত বলছি না৷ সেই ১৯৬০ সালে গ্রিক জাহাজ এমভি আলপাইন জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূলে অকেজো হয়ে আটকে পড়েছিল৷ পাঁচ বছর জাহাজটি আটকে ছিল৷ তারপর সেটিকে টেনে এনে ভাঙা শুরু হয়৷ শুরু থেকেই লাভজনক ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিতি পায়৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে৷ জাহাজ ভাঙা ব্যবসা শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে৷ শতাধিক ইয়ার্ড, দুই লক্ষের অধিক মানুষ এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন৷ এক কথায় কালক্রমে জাহাজ ভাঙা শিল্প বিশালত্ব লাভ করেছে৷ জাহাজ ভাঙা শিল্পের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় রড ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে৷ দেশের অর্থনীতিতে আরও বহুবিধ অবদান এই জাহাজ ভাঙা শিল্পের৷ তা সত্ত্বেও সমালোচনা, জাহাজ ভাঙা শিল্প বন্ধ করে দিতে হবে৷
২৷ জাহাজ ভাঙা শিল্পের সমালোচনার কারণগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক:
ক. জাহাজ ভাঙার পদ্ধতিগত দিকটিতে বাংলাদেশ এখনও প্রায় সেই প্রস্তর যুগে রয়ে গেছে৷ ব্যবসা থেকে শিল্পে রূপান্তর ঘটলেও কারিগরি বা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়নি বা এত কম হয়েছে যে, তা দৃশ্যমান নয়৷
খ. বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্প বিকশিত হয়েছে মূলত খুব সহজে শ্রমিক পাওয়া যাওয়ার কারণে৷ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা বা জীবনঝুঁকির বিষয়টি কোনো বিবেচনায় নেওয়া হয় না৷ দীর্ঘমেয়াদে শ্রমিকদের শারীরিক ক্ষতির দিকটিও সামান্যতম কোনো বিবেচনায় থাকে না৷
গ. যেসব শ্রমিক জাহাজ ভাঙেন, তাদের অধিকাংশই কোনো-না-কোনোভাবে তাৎক্ষণিক শারীরিক ক্ষতির শিকার হন৷ অনেকে হাত-পায়ের আঙুল হারান৷ শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ক্ষতের শিকার হন৷ চোখ-কানের সমস্যা হয়৷ দীর্ঘমেয়াদে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন৷
ঘ. সমুদ্রের পানি এবং আশপাশের উপকূলের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে৷ শ্রমিকরা তো বটেই, স্থানীয় জনগোষ্ঠীও এর ভুক্তভোগী৷ জটিল রোগে তারাও আক্রান্ত হয়ে পড়েন বা পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে জীবনযাপন করেন৷
ঙ. জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকরা প্রায় কোনো নীতি অনুসরণ করে ব্যবসা করেন না৷ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বিষাক্ত জাহাজও বাংলাদেশের মালিকরা কিনে আনেন৷ কখনো কখনো তারা এমন জাহাজ নিয়ে আসেন যা পৃথিবীর কোনো দেশ নিতে চায় না বা নেয় না৷ কিনে না, বিনা পয়সায়ও নেয় না৷ বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকরা সেই সব জাহাজ বিনা পয়সায় নিয়ে আসেন৷ বিষাক্ত জাহাজ অনেক কম মূল্যে কিনে আনেন৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ আছে, পারমাণবিক বর্জ্য বহন করা জাহাজও বাংলাদেশে আনা হয়েছে৷
৩৷ ভারতসহ পৃথিবীর আরও কিছু দেশে জাহাজ ভাঙা হয়৷ অভিযোগ সেইসব দেশেও আছে৷ সেসব দেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ বা সমালোচনার বিষয়গুলো কিছুটা হলেও গুরুত্ব দেন৷ সরকারও কিছু ক্ষেত্রে তাদের নিয়ম-নীতি মানতে, শ্রমিকের স্বার্থ দেখতে বাধ্য করেন৷
বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকরা নিজেদের সব নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে ভাবেন৷ শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বা স্বার্থ দেখার দিকটি তারা বিবেচনাতেই আনেন না৷ সরকার ‘এই করব, সেই করব' কখনো কখনো বলে, শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় না৷ পরিবেশ ক্ষতির দিকটিতে নজর দেয় না৷ সরকার মালিক পক্ষের ভাষায় কথা বলে৷ নীতি করে বা আইনের প্রয়োগে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে না৷
ফলে শ্রমিকের জীবনযাপন, নিরাপত্তা ঝুঁকি, পরিবেশ বিপর্যয় ইস্যুতে আন্দোলন হয় – জাহাজ ভাঙা শিল্প বন্ধ করে দিতে হবে৷
৪৷ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় জাহাজ ভাঙা শিল্প বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না৷ আবার যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতেও দেয়া উচিত নয়৷ জাহাজ ভাঙা শিল্প এলাকাটিতে মালিকরা আলাদা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন৷ ইচ্ছে করলেই সেখানে যাওয়া যায় না, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা যায় না৷ এই অবস্থায় সরকারের কিছু করণীয় আছে৷ শিল্পটি টিকিয়ে রাখার জন্যে করণীয় আছে মালিকদেরও৷
ক. জাহাজ ভাঙা কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকটি সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে৷ হেলমেট দিতে হবে৷ হাতুড়ি বাটালের পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে৷ শ্রমিকদের কিছুটা ট্রেনিং দিলেই তারা প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠবেন৷
খ. কত পুরনো জাহাজ দেশে আনা যাবে, তা শুধু কাগুজে নীতি করলে হবে না৷ নিয়মিত মনিটরের আওতায় আনতে হবে৷ কোন ধরনের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ সম্পৃক্ত জাহাজ দেশে আনা যাবে না, তা নিয়মের মধ্যে এনে বাস্তবায়ন করতে হবে৷
গ. কোন জাহাজে বিষাক্ত পদার্থ কোন মাত্রায় আছে, তার পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে৷ রাসায়নিক পরীক্ষা সম্পন্ন না করে শ্রমিকদের দিয়ে জাহাজ ভাঙানো যাবে না৷ এ সব ক্ষেত্রে নিয়ম অনুসরণ না করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে৷
ঘ. শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিকদের বাধ্য করতে হবে৷ শ্রমিকের অঙ্গহানি বা জীবনহানি হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে৷ খুব গুরুত্ব দিতে হবে সকল শ্রমিক-কর্মচারীর ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থার দিকে৷ বিশেষ করে জীবন-ঝুঁকি বা অঙ্গহানির আশঙ্কা আছে সেসব ক্ষেত্রে, তাদের ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা থাকতেই হবে৷
ঙ. মজুরি বৃদ্ধি করলে, ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করলে, নিরাপত্তা বা জীবনের মানের উন্নয়নের জন্যে অর্থ ব্যয় করলে, জাহাজ ভাঙা শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে৷ এই অসত্য কথা বলা, বাংলাদেশের শিল্প মালিকদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য৷ পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্পসহ সব মালিকের চরিত্র একই রকম৷ সরকার যদি কঠোর হয়, গরিব শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নেয়, মালিকদের লাভের পরিমাণ সামান্য কমবে৷ শ্রমিকরা লাভবান হবে, অঙ্গহানি বা মৃত্যু কমবে৷ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশেরও উন্নয়ন হবে৷
৫৷ শ্রমিকদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়, পৃথিবীতে বাংলাদেশের জাহাজ শিল্প নিয়ে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে৷ এর থেকে বের হয়ে আসার জন্যে দেশের সরকারের উদ্যোগ তো দরকার বটেই, মালিকদেরও মানসিকতা পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়৷ এক্ষেত্রে দায়িত্ব আছে উন্নত দেশগুলোরও৷ যারা তাদের সবচেয়ে পুরনো বিষাক্ত জাহাজ বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে৷ এ সব জাহাজ বাংলাদেশে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত তাদেরও নিতে হবে৷
সম্মিলিত উদ্যোগে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পের, আরও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ আছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷