কুমোরটুলিতে লোকসানের অশনিসংকেত
১০ আগস্ট ২০১৭পয়লা জুলাই জিএসটি বা পণ্য পরিষেবা কর চালু হওয়ার পর বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে৷ করের হার বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ব্যবসায় বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন৷ তবে অনেক পণ্যে করের হার কমায় কোনো কোনো মহল থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে৷ কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে আশঙ্কার মাত্রাটাই বেশি৷ কলকাতার কুমোরটুলিও তার ব্যতিক্রম নয়৷ কুমোরপাড়ায় ঘুরে মৃৎশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের আঁচ পেল ডয়চে ভেলে৷শ্রাবণের বিকেলে তখন তুমুল ব্যস্ততা কুমোরপাড়ায়৷ কয়েকদিন আগেই একটানা প্রবল বৃষ্টিতে প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় ভেস্তে গিয়েছিল৷ চলতি বর্ষায় যে তার রেশ এখনও কাটেনি, দু'পাশে সার দেওয়া শিল্পালয়ে পলিথিনে ঢাকা প্রতিমা দেখে তা বোঝা যাচ্ছিল৷ কোথাও শুধু মাটির প্রলেপ পড়েছে৷ কোথাও প্রথম দফার রঙের পোঁচ৷ প্রতিটি ঘরে শিল্পীরা ব্যস্ত প্রতিমার রূপদানে৷ ফি বছরের মতো বৃষ্টির প্রকোপ থেকে এবারও নিজেদের আড়াল করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এই শিল্পীরা৷ কিন্তু এই বর্ষায় সুনামির মতো তাঁদের উপর আছড়ে পড়েছে জিএসটি-র ঢেউ৷ তাই শিল্পীদের গলায় পণ্য পরিষেবা কর নিয়ে একরাশ উদ্বেগ৷
মৃৎশিল্পে সঙ্কট কতটা তার হিসেব নিতে ডয়চে ভেলে মুখোমুখি হয়েছিল মৃৎশিল্পী সংস্কৃতি সমিতির সম্পাদক রঞ্জিত সরকারের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘নোটবাতিলের পর জিএসটি – একবছরের মধ্যে পরপর দু'টো ধাক্কা সামলানো যাচ্ছে না৷ ঠিক পুজোর মুখে আমাদের ভরা মরশুমে জিএসটি চালু হওয়ায় সমস্যা বেড়েছে৷ জিএসটি নম্বর নেওয়া, হিসেবপত্র সামলাতে একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখতে হবে মনে হচ্ছে৷ এটা আমাদের কাছে বাড়তি বোঝা৷’’
রঞ্জিতবাবু নিজে প্রতিমার সাজসজ্জার ব্যবসা করেন – দেবীর শাড়ি, অস্ত্র থেকে মহিষাসুরের বস্ত্র, গয়না থেকে চুল ইত্যাদি৷ তাঁর ঘরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে এ সবের নমুনা৷ প্রতিমার মাটির কাজ প্রায় সারা, এ বার এই সাজসজ্জা ও রং নিয়ে ক্ষতির আশঙ্কা করছে কুমোরটুলি৷ কেন? রঞ্জিতবাবু বলেন, ‘‘প্রতিমার সাজসজ্জার বিভিন্ন পণ্যে জিএসটি বসেছে, করের হার বেড়েছে৷ যেমন ধরুন কাঁচা পাটে জিএসটি নেই, কিন্তু তাতে রং করা হলে, অর্থাৎ চুল তৈরির পর ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে৷ অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রে কর বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ৷ রঙের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ হার, ২৮ শতাংশ৷ ফলে প্রতিমা তৈরির খরচ বাড়ছে৷’’
এই বাড়তি খরচ কীভাবে পোষাবেন মৃৎশিল্পীরা? রঞ্জিতবাবু বলেন, ‘‘রথের পর থেকে বায়না শুরু হয়ে গেছে৷ তখন বুঝতে পারিনি জিএসটি-র ফলে দাম কতটা বাড়বে৷ এখন দেখছি, খদ্দেরের কাছে যা দাম চেয়েছি, প্রতিমা তৈরির খরচ প্রায় তার কাছাকাছি পড়ে যাচ্ছে৷ এখন ক্রেতার কাছে বাড়তি দাম চাইলে তারা দেবে কেন? ফলে আমাদের লাভের অঙ্ক কমবে, অনেকের লোকসানও হতে পারে৷''
জিএসটি-র ফলে যে সমস্যা দানা বাঁধছে, সেটা অবশ্য বেশ কিছুদিন আগেই টের পেয়েছিলেন মৃৎশিল্পীরা৷ কীভাবে?
আরেক সাজশিল্পী ও ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ দে বলেন, ‘‘গুজরাটের সুরাট থেকে যে সাজের জিনিস আসে, সে সব আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ সাজের জিনিস বলতে প্রতিমার বস্ত্র, বাঘছাল ইত্যাদি৷ জিএসটি-র জেরে সেখানকার মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ বস্ত্রের উপর ১৮ শতাংশ কর বসিয়েছিল সরকার, সেটা এখন কমে ৫ শতাংশ হয়েছে৷ তার পর আবার সাজের সামগ্রী আসতে শুরু করেছে, কিন্তু মাঝখানে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷’’
কুমোরটুলিতে দুর্গা পুজোর মরশুম শুরু হওয়ার পরপরই ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বাড়ে৷ উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশার বহু ব্যবসায়ী কুমোরটুলিতে আসেন প্রতিমার সাজ কিনতে৷ রঞ্জিতবাবু জানান, অন্যান্যবার পুজোর একমাস আগে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ সাজের সামগ্রী বিক্রি হয়ে যেত৷ এ বার ওই ব্যবসায়ীরা আসেননি৷ তাই বিক্রিবাটার হাল ভালো নয়৷ প্রতিমার রপ্তানিও একসময়ে থমকে গিয়েছিল জিএসটি-র জেরে৷ গত বছর ৪০-৪২টি প্রতিমা বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল৷ এ বার ৩৫-৩৬টি প্রতিমার বায়না রয়েছে৷ জুলাইয়ের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রতিমা বিদেশে পাঠানোর কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ এখন আবার তা শুরু হয়েছে৷
এ সব মিলিয়ে জিএসটি-র প্রভাবে ব্যবসার লাভ-ক্ষতি নিয়ে একেবারে অন্ধকারে রয়েছেন মৃৎশিল্পীরা৷ কতটা লোকসানের আশঙ্কা করছেন তাঁরা? মৃৎশিল্পী জয়ন্ত পাল বলেন, ‘‘এক-একটা প্রতিমা তৈরিতে কত খরচ, তার হিসেব কোনো বছরেই আমাদের কাছে থাকে না৷ যে কটি প্রতিমা তৈরি হচ্ছে, তার মোট হিসেব থাকে৷ এ বার খরচ বাড়ছে বুঝতে পারছি, কিন্তু সেটা কতটা, তার আন্দাজ করা যাচ্ছে না৷ জিএসটি-র প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে ধোঁয়াশা অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রের মতো মৃৎশিল্পেও রয়েছে৷'' জয়ন্তবাবুর ভাষায়, ‘‘শিল্পীরা বেশি শিক্ষিত নয়৷ এত হিসেবের মারপ্যাঁচ তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়৷ এ জন্য অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখতে হবে৷ সেটা একটা বাড়তি খরচের বোঝা৷’’
এমনিতেই বহু প্রাচীন কুমোরটুলির এই শিল্পে আর্থিক সঙ্কট থাবা বসিয়েছে৷ শিল্পের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় কারিগর পেতে সমস্যা হচ্ছে৷ শিল্পী সনাতন পান্ডার প্রশ্ন, ‘‘তিন হাজার টাকায় কে কুমোরপাড়ায় কাজ করতে আসবে বলুন? তাই এ কাজে আগ্রহ কমছে, দক্ষ শিল্পীরাও অন্য কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন৷ জিএসটি-র ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলেই আমাদের ধারণা৷’’
এই শিল্পীরাই দুর্গতিনাশিনীর মৃন্ময়ী রূপের কারিগর৷ কুমোরটুলি ঝুপসি, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে তৈরি হওয়া প্রতিমাই মণ্ডপ আলো করে রাখবে পুজোর কয়েকটা দিন৷ শুধু কলকাতা বা বাংলা নয়, তার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন রাজ্য বা বিদেশে উৎসব জমে উঠবে৷ খরচ হবে কোটি কোটি টাকা৷ কিন্তু মৃৎশিল্পের দুর্গতি কে ঘোচাবে?