পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের ঝোঁক
১১ মে ২০১৯পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা বদলের সঙ্গে রাজনীতির রং বদল হয়েছে৷ বাম ও ডানপন্থি মতবাদের যে তীব্র লড়াই দশকের পর দশক দেখা গিয়েছে, তার চরিত্র বদলে যাচ্ছে৷ মতাদর্শের বদলে জায়গা করে নিচ্ছে ধর্ম৷ পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে রামনবমী, শোনা যাচ্ছে জয় শ্রীরাম ধ্বনি৷ এই প্রবণতা এতটাই প্রবল হয়ে উঠছে যে, পশ্চিমবঙ্গের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে এই স্লোগানে৷ নির্বাচনি প্রচারে পশ্চিম মেদিনীপুর সফর করার সময় চন্দ্রকোণার রাধাবল্লভপুর গ্রামের পাশ দিয়ে মমতার কনভয় যাচ্ছিল৷ এই পথে মুখ্যমন্ত্রী যাবেন বলে অপেক্ষা করছিল জনতা৷ একটি স্থানে মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কয়েকজন যুবক ‘জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দেন৷ ক্ষিপ্ত মমতা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন৷তাঁকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই যুবকরা দৌড়ে পালায়, মুখ্যমন্ত্রী তাদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন, ‘‘কী হলো, পালাচ্ছিস কেন? আয় আয়, পালাচ্ছিস কেন?''
এই ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়৷ পরে পুলিশ রাধাবল্লভপুরের তিন যুবক সীতারাম মিদ্যা, বুদ্ধদেব দোলুই, সায়ন মিদ্যাকে আটক করে৷ এই তিন বিজেপি কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়েও দেয়া হয়৷
এই ছোট ঘটনায় বড় প্রতিক্রিয়া হয়েছে চলতি নির্বাচনে৷ খোদ প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে তরজায় জড়িয়ে পড়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে জয় মা দুর্গা, জয় মা কালী বলা যাবে না? জয় শ্রীরাম বলা যাবে না? যে বলবে, তাকে জেলে ভরে দেবে রাজ্য সরকার?'' বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের মন্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ কি পাকিস্তানের অংশ যে, এখানে রামের নাম করা যাবে না?''
বাংলার রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রবণতা বাড়ছে৷ রামকে নিয়ে বিতর্ক সেই প্রবণতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে৷ মেরুকরণের তীব্রতা বেড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর জবাবে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘বিজেপির স্লোগান আমি দেবো না৷ জয়হিন্দ, বন্দেমাতরম বলব, কিন্তু ওদের স্লোগান দেবো না৷ প্রতিবার ভোটের সময় রাম ওদের নির্বাচনি এজেন্ট হয়ে আসেন৷''
পুরাণের চরিত্র রাম ভারতীয়দের কাছে আরাধ্য, যদিও বাঙালিদের ক্ষেত্রে এই কথা পুরোপুরি খাটে না৷ কিন্তু, এবারের নির্বাচনে সেই রামের বিরাট ছায়া পড়েছে বাংলায়৷ তবে একে তৃণমূল সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছে বিজেপি, যেটা ধর্মীয় স্লোগানের মোড়কে সামনে এসেছে৷ ঘাটালের বিজেপি সভাপতি অন্তরা ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ৷ বিভিন্নভাবে সেটা সামনে আসছে৷ এই ঘটনা তারই প্রমাণ৷ গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে৷'' তবে পশ্চিম মেদিনীপুরের তৃণমূল জেলা সভাপতি অজিত মাইতি একে স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ বলে মানতে রাজি নন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বিজেপির চক্রান্ত৷ ওই এলাকা আরামবাগ লোকসভার মধ্যে পড়ে৷ যদি ক্ষোভ থাকত, তাহলে বিজেপি ওখানে ভোটের দিন বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি কেন?''
প্রসঙ্গত, আরামবাগ ভোটকেন্দ্রের ভোট নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে৷ তৃণমূল সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের পিটিয়ে বের করে দেয়ার একাধিক অভিযোগ উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমের খবরে৷
এবার তৃণমূলের ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতেও মুখ্যমন্ত্রীকে কার্যত চ্যালেঞ্জ জানানোর যে দুঃসাহস যুবকরা দেখিয়েছে, তার নেপথ্যে ক্ষোভ রয়েইছে৷ যেমন, সীতারাম মিদ্যা ইমামদের ভাতা দেওয়ার রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ আবার তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি বিজেপি কর্মী বলে কোথাও আমাকে কাজে টিকতে দেয়নি তৃণমূল৷ এর আগে দু রকমের কাজ থেকে সরিয়ে দিয়েছে৷ এখন শ্রমিকের কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছি৷ তাই মুখ্যমন্ত্রীকে ভালোবেসে প্রতিবাদ জানিয়েছি৷ কেবল জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়েছি৷'' রাধাবল্লভপুরের তিন কর্মীকে গত মঙ্গলবার সংবর্ধনা দিয়েছে বিজেপি৷ বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, ওঁদের সাহসিকতায় দলের কর্মীদের মনোবল বেড়েছে৷ সবাই এই সাহস নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়বেন৷
চন্দ্রকোণার ঘটনার রেশ কাটার আগেই উত্তর ২৪ পরগনায় রাম ধ্বনির পুনরাবৃত্তি দেখা গিয়েছে৷ বিধানসভা উপনির্বাচনের তৃণমূল প্রার্থী মদন মিত্রের রোড শো চলাকালীন কাঁকিনাড়ায় বিজেপি কর্মীরা ফের একবার জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়েছেন৷ এই বিতর্কে পুরোনো প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আসছে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মকে হাতিয়ার করা কি উচিত? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অনিন্দ্য বটব্যাল বলেন, ‘‘ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম সম্পৃক্ত হয়ে আছে৷ ব্যাপারটা খুবই জটিল৷ এই ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে৷ রামের ধ্বনিকে ধর্মের গণ্ডী পার করে রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে আসা হয়েছে নিখাদ রাজনৈতিক কারণে৷ সেটা এখন রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে উঠেছে৷'' অনেকেই মনে করছেন, জয় শ্রীরাম ধ্বনির মাধ্যমে হিন্দুত্বের বার্তা পৌঁছে দেওয়াই উদ্দেশ্য বিজেপির৷ সেই লক্ষ্যে তারা কতটা সফল, তা বোঝা যাবে ২৩ মে ফলপ্রকাশের পর৷ তবে এবার সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে একজোট হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন৷