টরন্টোর স্মার্ট শহরকে ঘিরে ঘোর বিতর্ক
১৭ মার্চ ২০১৯টরন্টোর দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পরিত্যাক্ত বিশাল এক ভূমি৷ নদী তীরবর্তী জায়গাটি একসময় ব্যবহার হতো ডকল্যান্ড হিসেবে৷ এখানেই এখন নতুন এক আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠছে৷ পরিকল্পনাটি অবশ্য আলাদা এক স্মার্ট শহর গড়ে তোলারই৷ সেই মাস্টারপ্ল্যানটি ৩২৫ হেক্টর জমি ঘিরে৷ প্রকল্পটির নাম ‘সাইডওয়াক টরন্টো’, যার নির্মাতা হিসেবে দায়িত্বে আছে গুগলের মালিক অ্যালফাবেটের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘সাইডওয়াক ল্যাবস’৷
ক্যানাডার সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়াটার ফ্রন্টের আহবানে প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দেয় তারা ২০১৭ সালের মার্চে৷ সে অনুযায়ী চলতি বছরই সেখানে ৪.৮ হেক্টর বা ১২ একরের উপর একটি পরীক্ষামূলক শহর গড়ে তুলবার কথা রয়েছে৷
বিতর্ক যেখানে
পরিকল্পনা অনুযায়ী সাইডওয়াক টরন্টোর ভবন আর সড়ক আলোকিত হবে সৌর বিদ্যুতে৷ সড়কের নীচ দিয়ে গাছের শেকড় বিস্তারের জন্য ভূগর্ভস্থ বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে, যাতে বড় আকারের গাছও সেখানে জন্মাতে পারবে৷ এতে অন্য শহরের তুলনায় এই ‘স্মার্ট সিটি’ তুলনামূলক বেশি সবুজ থাকবে৷
নাগরিকদের প্রতিদিনকার কর্মকাণ্ডের উপাত্তের উপর ভিত্তি করে শহরটিতে ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রা ছয়গুণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সবুজ বেষ্টনী থেকে শুরু করে সাইকেলের পথ, এই প্রকল্পের সবকিছুই ভবিষ্যতের টেকসই উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে নেয়া হয়েছে৷ থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে এমনটাই জানিয়েছেন সাইডওয়াক ল্যাবসের এক মুখপাত্র৷ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক চার্লট ম্যাথিউস বলেন, ‘‘টরন্টোর উপশহরগুলোতে বছরে জনপ্রতি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণের হার ৬.৩ টন৷ আমরা বিশ্বাস করি এটি এক টনে নামিয়ে আনতে সক্ষম হব৷’’
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়কে সামনে এনে সাইডওয়াক ল্যাবস তার মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করছে৷ ক্যানাডার মানুষের ব্যক্তিগত ডেটা বা উপাত্ত হাতিয়ে নেয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বিশাল মুনাফার পরিকল্পনা এঁটেছে বলে শঙ্কা তাঁদের৷ এর জবাব দিয়ে ম্যাথিউস বলছেন, ‘‘আমরা সেই ধরনের ডেটাই নেব, যা বিদ্যমান রয়েছে এবং সেগুলোর মাধ্যমে আমাদের ভবনগুলোকে আরামপ্রদ এবং সংবেদনশীল হিসেবে গড়ে তোলা হবে৷ এটা হবে বৈপ্লবিক একটা ব্যাপার৷’’
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ৫৫ ভাগ মানুষ শহরে বসবাস করছে৷ ২০৫০ সাল নাগাদ যা ৬৮ ভাগে পৌঁছাবে৷ শহরের ব্যাপকতা যত বাড়ছে, তত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ও জলবায়ুর উপর চাপ তৈরি হচ্ছে৷ এই সংকট মোকাবেলায় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই বিতর্ক চলছে৷
স্থায়ী নজরদারি ব্যবস্থা
সাইডওয়াক টরন্টোতে নগরবাসী কী ধরনের বর্জ্য ফেলছে তা পর্যবেক্ষণে থাকবে ডিজিটাল ব্যবস্থা৷ এর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য বর্জ্য দ্রুত সনাক্ত করে সেগুলো আলাদা করা সম্ভব হবে৷
নগরবাসীর বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরণের উপকরণ ব্যবহারের ধরণ জানতে ডেটা আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্য নেয়ার পরিকল্পনাও আছে নির্মাতাদের৷ শুধু তাই নয় শহরের বাসিন্দারা কে সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন, কখন থালা বাসন ধোয়ার যন্ত্রটি চালু করেন এমন সব তথ্য পর্যন্ত সংগ্রহ করবে সাইডওয়াক ল্যাবস৷ জলবায়ুবান্ধব একটি ব্যবস্থা বা প্রযুক্তি গড়ে তুলতে নাকি মানুষের জীবন যাপনের প্রতিটি তথ্যই তাদের প্রয়োজন হবে৷
কিন্তু অন্টারিওর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড মুরাকামি উড এই দাবি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তিনি মনে করেন, ‘‘প্রতিষ্ঠানটি যেসব সুবিধা দিতে চাচ্ছে সেগুলো বিভিন্ন শহরে এরিমধ্যে বিদ্যমান রয়েছে৷ এর জন্য নতুন করে ব্যক্তিগত তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহের কোনো প্রয়োজন নেই৷’’ এই প্রস্তাবকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার নামে স্থায়ী নজরদারি এবং ডেটা সংগ্রহের বড় ধরনের পায়তারা বলে উল্লেখ করেন তিনি৷ ‘‘তারা মূলত আমাদের শহরকে বৃহৎ আকারে বেসরকারিকরণের গবেষণায় নেমেছে৷ আর এর সব কিছুর মেধাসত্ত্ব থাকবে তাদের দখলে,’’ বলেন উড৷
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বনাম প্রযুক্তি
এই প্রকল্পের কারণে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার গুরুত্ব আর টেকসই উন্নয়নে ডেটার ভূমিকা নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে ক্যানাডাতে৷ যা নিয়ে সরকারি অর্থায়নে একটি জরিপও চালিয়েছে ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়৷ তাতে ৮৮ ভাগ ক্যানাডিয়ানই বলেছেন ‘স্মার্ট সিটি’-র ডেটা ব্যবহার নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন৷ যাদের মধ্যে ২৩ ভাগ তাদের অতিমাত্রায় উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন৷ বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেটা সংগ্রহ করলে নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি ভয়ে থাকেন বলেও জরিপে উঠে আসে৷ ৯১ ভাগ ক্যানাডিয়ানই তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন৷ এই উদ্বেগকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করেন জরিপ পরিচালনাকারী গবেষকদের একজন অ্যাঙ্গেলা ওরাশ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এমন একটি ব্যবস্থায় বাস করি যেখানে সম্পদের মালিকানাকে মূল্যায়ন করা হয়৷ সেদিক থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই ডেটা তার মূল্যবান সম্পদ৷’’
এই বিতর্ক কমাতে নতু্ন একটি নীতি প্রণয়নের দাবিও উঠে এসেছে সেখানে৷ যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা ও ডেটা ব্যবহারের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা সম্ভব হবে৷ এমন অবস্থায় এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ সময় লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷ অনুমোদন দেয়া হলে বাকি ছয় মাসের মধ্যেই নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে বলে দাবি করেছে সাউডওয়াক ল্যাবস৷
এফএস/জেডএইচ (রয়টার্স, সাইডওয়াক ল্যাবস)
টরন্টোর মতো স্মার্ট শহরে থাকতে চান? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷