টাকা বাতিলে আতঙ্ক সর্বত্র
৯ নভেম্বর ২০১৬মঙ্গলবার সন্ধেয় এক টিভি ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সেদিনই মধ্যরাত থেকে বাতিল হয়ে যাচ্ছে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার কারেন্সি নোট৷ পরের এক দিন বন্ধ থাকবে দেশের সব ব্যাংক এবং দু'দিন বন্ধ থাকবে সব এটিএম৷ পুরনো নোট বদল করা যাবে বৃহস্পতিবার থেকে, কিন্তু দিনে চার হাজার টাকার বেশি নয়৷ সেদিন থেকে ব্যাংকের কাউন্টারে সরাসরি টাকা তোলা যাবে, কিন্তু দিনে ১০ হাজার এবং সপ্তাহে ২০ হাজার টাকার বেশি নয়৷ সেই টাকা পাওয়া যাবে নতুন ৫০০ টাকা এবং ২০০০ টাকার কারেন্সি নোটে৷ শুক্রবার থেকে চালু হবে এটিএম, কিন্তু তার থেকেও দিনে আপাতত ২০০০ টাকার বেশি তোলা যাবে না৷ প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, এই ব্যবস্থা সাময়িক এবং ক্রমশ টাকা তুলতে দেওয়ার পরিমাণ বাড়ানো হবে৷ এবং বৃহস্পতিবার থেকেই পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার বাতিল নোট ব্যাংকে জমা করা যাবে, যার কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই৷ ৩০সে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাতিল নোট সমস্ত ব্যাংকে এবং ডাকঘরেও জমা করা যাবে৷ যাঁরা কোনো কারণে তার মধ্যে টাকা জমা করতে পারবেন না, তাঁদের জন্যে ৩১শে মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু টাকা জমা করার সময় বৈধ সরকারি পরিচয়-পত্র, যেমন ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড অবশ্যই দেখাতে হবে৷
কেন এই সার্জিকাল স্ট্রাইক?
নরেন্দ্র মোদী তখনই জানিয়ে দেন, কেন হঠাৎ জরুরি ভিত্তিতে এই ব্যবস্থা নিতে হলো৷ প্রথম কারণ, সীমান্তের ওপার থেকে যারা ভারতের মাটিতে সন্ত্রাস, নাশকতায় মদত দেয়, তাদের অন্যতম অস্ত্র জাল ভারতীয় টাকা৷ এই এক ধরনের অর্থনৈতিক নাশকতা, যেখানে জাল টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেওয়া যায়, আবার নাশকতা চালানোর খরচও দেওয়া যায়৷ আর দ্বিতীয় কারণ, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভারতে কালো টাকার মজুত নষ্ট করা৷ লক্ষ কোটি টাকা এদেশে থাকে ব্যাংকের বাইরে, সরকারের নজর এড়িয়ে, যার জন্য কানাকড়ি কর দেওয়া হয় না সরকারকে, কিন্তু বিভিন্ন ধরনের লেনদেনে যে কালো টাকা মিশে যায় বৈধ অর্থনীতির মূলস্রোতে৷ যদি হিসেব করা যায়, তা হলে ভারতে এই কালো টাকার পরিমাণ জাতীয় গড় উৎপাদনের অন্তত ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ এক বিপুল পরিমাণ টাকা৷
উল্লেখ্য, চলতি আর্থিক বছরেই কেন্দ্রীয় সরকার একটা প্রকল্প চালু করেছিল, যেখানে নিজের অবৈধ সম্পদ বা কালো টাকার কথা প্রকাশ করে জরিমানা দেওয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ ছিল৷ অনেকেই এই সময় নিজের গচ্ছিত বেআইনি পুঁজির কথা কবুল করে, তার ওপর ধার্য আয়করই কেবল দিয়ে জরিমানা বা শাস্তি এড়িয়েছে৷ কিন্তু সরকারের অনুমান নির্ভুল ছিল যে, যে টাকা প্রকাশ্যে এলো, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ টাকা গোপন রইল৷ ফলে সরকারের এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত, যাতে হয় নিজেদের কালো টাকা উড়িয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করতে হবে, অথবা ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে ধরা পড়তে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে৷ এছাড়া ভবিষ্যতেও যাতে কালো টাকার মজুত আটকানো যায়, সেজন্য ২০০০ টাকার কারেন্সি নোট ভারতে এই প্রথম চালু হবে৷ পাশাপাশি আমূল বদলে ফেলা হবে ৫০০ টাকার নকশা, যুক্ত হবে এক কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা, যাতে বাজারে জাল টাকা এলে সঙ্গে সঙ্গে ধরা যায়৷
জিপিএস ট্র্যাকার নিয়ে ভুল খবর
দু'দিন ধরেই খবরটা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে খুব চোখে পড়ছিল৷ জানা গিয়েছিল, এই ২০০০ টাকার নোটের মধ্যে নাকি বসানো থাকবে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি জিপিএস ট্র্যাকার৷ ফলে টাকার অবস্থান এবং গতিবিধি উপগ্রহ মারফৎ জানা যাবে৷ এক জায়গায় খুব বেশি টাকা, অনেক টাকা খুব বেশি দিন ধরে এক জায়গায় জমা থাকা – সবই ধরা পড়বে এই নতুন প্রযুক্তিতে৷ এমনকি মাটির নীচে ১২০ মিটার গভীরেও এই টাকার সন্ধান পাবে উপগ্রহ৷
হ্যাঁ, খবরটা ভুল৷ কারণ ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও জিপিএস ট্র্যাকার-সমৃদ্ধ এমন ২০০০ টাকার নোটের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন৷ অবশ্য সে যাই হোক না কেন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের যে সত্যিই খুব অসুবিধে হলো, সেটা বলাই বাহুল্য৷ যে কারণে নাগরিকদের অনেকেই এই জরুরি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও প্রশ্ন তুলেছেন এর পদ্ধতি এবং প্রয়োগ নিয়ে৷ রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেমন বামপন্থিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই সিদ্ধান্তকে হঠকারী এবং জনবিরোধী বলে সমালোচনা করেছেন৷ এবং এঁরা নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের কথাই বলেছেন, যাঁরা তৈরি ছিলেন না এই হঠাৎ সিদ্ধান্তের জন্য৷
হয়রানি সত্ত্বেও সফল সিদ্ধান্ত
এদিকে মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত কলকাতা শহরের রাস্তায় এটিএমগুলোর সামনে ছিল লম্বা লাইন৷ এবং যেহেতু একবারে বেশি টাকা তুললে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটই পাওয়া যাবে, যা মধ্যরাতেই বাতিল কাগজ হয়ে যাবে, সেজন্য লোকে বারে বারে কম টাকা তোলার চেষ্টা করেছেন৷ তাতে সময় যেমন বেশি লেগেছে, বাইরে বিরক্ত মানুষের সারি আরও দীর্ঘ হয়েছে, তেমন ব্যাংকগুলোর সার্ভারও ধীরগতি হয়ে গেছে৷ বহু এটিএম কিছুক্ষণের মধ্যেই টাকা শেষ হয়ে অকেজো হয়ে গেছে৷ মাঝরাত থেকেই শুরু হয়ে গেছে এক শ্রেণির লোকের কালোবাজারি, যারা ১২০ টাকার বিনিময়ে ১০০ টাকার নোট দেদার বিক্রি করেছে৷ বুধবার সকাল থেকে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে পড়ে, যখন কোনো দোকানে ৫০০, বা ১০০০ টাকার নোট আর চলছিল না৷ যদিও সরকার ঘোষণা করছিল, পেট্রল পাম্পে, সরকারি হাসপাতালে, ওষুধের দোকানে ঐ সব পুরনো নোট নেওয়া হবে৷ কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক জায়গাতেই তারা বাতিল নোট নিতে অস্বীকার করেছে এবং এই ঘটনা ঘটেছে সারা দেশজুড়ে৷
আবার একই সঙ্গে দেশজুড়ে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে, যা পরোক্ষে প্রমাণ করেছে মোদী সরকারের এই সার্জিকাল স্ট্রাইকের সাফল্য৷ অনেক শহরে, বিশেষত মুম্বই, দিল্লি, বা হায়দ্রাবাদে শোনা গেছে, অন্যের নামে ব্যাংকে টাকা জমা করার প্রস্তাব পাচ্ছে লোকে৷ কেউ জমা করতে চান ৫০ লক্ষ, তো কেউ ৫০ কোটি৷ নিজের নামে, নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করলে ধরে পড়ে যাবেন বলে এরা অভাবী লোক খুঁজছেন, যারা মোটা টাকার কমিশনের বিনিময়ে নিজেদের অ্যাকাউন্টে ভাগ করে করে টাকা জমা করবেন, যে টাকা আবার একটু একটু করে ফিরে চলে যাবে আসল মালিকের হাতে৷ অর্থমন্ত্রীর কথায়, ভারতের প্রত্যেক সৎ নাগরিকের সরকারের এই সার্জিকাল স্ট্রাইকের সিদ্ধান্তে খুশি হওয়া উচিত৷
তবে এটাও ঠিক যে, যাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, যাঁরা দিন আনি দিন খাই, তাঁরা খুব অসুবিধায় পড়েছেন৷ অসুবিধায় পড়েছেন বয়স্ক পেনশনভোগীরা, বা মধ্যবিত্ত মানুষ, যাঁরা আগের দিনই ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোটে সংসার খরচ তুলে এনেছেন৷ অন্যদিকে এটাও ঠিক, এঁদের মধ্যে অনেকেই বলছেন যে, দু'দিনের অসুবিধে তাঁরা সহ্য করে নিতে রাজি, যদি দেশ থেকে উধাও হয় কালো টাকার ভূত৷ যদি বাজার থেকে নকল নোট সরে যায়, যদি টাকার দাম বাড়ে, মুদ্রাস্ফীতি কমে, যদি সহজলভ্য হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী৷ এই মানুষগুলো কিন্তু চরম অসুবিধে সত্ত্বেও স্বাগত জানাচ্ছেন এই নয়া ব্যবস্থাকে৷