টাকার পাহাড় দেখে লজ্জা করছে
২৮ জুলাই ২০২২দুর্নীতির এমন চেহারা আগে কখনো দেখেনি পশ্চিমবঙ্গ। মেঝেয় পড়ে পাঁচশ ও দুই হাজারের নোটের বান্ডিলের স্তূপ। অন্যদিকে সোনার বাট, বিশাল বিশাল নেকলেস, চওড়া বালা এবং আরো কত কী গয়না। দেখে মনে হচ্ছে, গোটা সোনার দোকানই যেন উঠে চলে এসেছে ফ্ল্যাটের ঘরে। এই ফ্ল্যাট পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের। আগে তার একটি ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গিয়েছিল ২২ কোটি, এবার পাওয়া গেল ২৮ কোটি, সবমিলিয়ে ৫০ কোটি। তার উপর কোটি পাঁচেকের সোনা ও গয়না।
স্কুলে পড়ার সময় একটা রচনা আমাদের সময়ে সবাইকে লিখতে হয়েছে, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন। এখন টাকার দাম এতটাই পড়ে গেছে যে, কেউ আর লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে না। কোটি টাকার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবে যখন এক মন্ত্রীর বান্ধবীর দুইটি ফ্ল্যাট থেকে ৫০ কোটি টাকা পাওয়া যায়, তখন মনে হয়, কোটি টাকার স্বপ্নও একেবারে আলুনি হয়ে গেছে। আর প্রতিদিনই খবর আসছে, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পার্থ-অর্পিতার বাড়ি-জমির কথা। অভিযোগ, সেসব বাড়ি এবং বিপুল পরিমাণ জমিও কোটি কোটি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে, যে ৫০ কোটি টাকা ও পাঁচ কোটির গয়না উদ্ধার হয়েছে, তা সম্ভবত ট্রেলার, পিকচার এখনো বাকি।
এই ট্রেলার দেখেই তো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যতই টাকার টানাটানি থাকুক না কেন, শিল্পহীন রাজ্যের অর্থনীতি যতই দুর্বল হোক না কেন, রাজনীতিকের কাছে, তার বান্ধবীর অর্থনীতিতে মন্দার ছায়ামাত্র নেই। তাদের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠেছে। তার উপর আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, আড়ালে-আবডালে কান পাতলে শোনা যায়, রাজনীতিক, শিল্পপতিরা ঘরে টাকা রাখেন কম, বেশিরভাগটা দেশে-বিদেশে পাচার করে দেন, বিনিয়োগ করেন। তা পার্থ-অর্পিতা সেরকম কিছু করেছেন কিনা, তা তদন্ত আরো এগোলে টের পাওয়া যাবে। আপাতত যা পাওয়া গেছে, তাতেই আম-বাঙালির চোখ কপালে উঠেছে। এরকম দুর্নীতির টাকা গোনার লাইভই বা কবে দেখেছে বাঙালি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মতো যেখানে চার-ছয়ের বন্যায় স্কোর হুহু করে বাড়ছে।
ইডি বা সিবিআই বলেনি, তবে অনুমান করা যেতেই পারে এই অর্থের উৎস এসএসসি কেলেঙ্কারি। কারণ, সূত্র বলছে, এসএসসি সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি ইডি দুইটি ফ্ল্যাট থেকেই উদ্ধার করেছে। দুটো ছবি পাশাপাশি রাখুন। অর্পিতার ফ্ল্যাটে টাকার পাহাড়ের ছবি, অন্যদিকে কলকাতাতেই গান্ধী মূর্তির সামনে বিক্ষোভকারীদের ছবি। তারা পরীক্ষা দিয়ে পাস করে যোগ্যতামান পেরোনোর পরেও চাকরি পাননি। রাস্তার ধারে বসে লড়ে যাচ্ছেন। কারো সন্তান জন্মের আটদিন পরে মারা গেছেন, কেউ স্বামী-বাচ্চাকে নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, কেউ ক্যানসারের মতো রোগকে সঙ্গী করে দিনের পর দিন বিক্ষোভ দেখিয়ে গেছেন। শুধু অর্থের জোর থাকায় তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অন্যরা চাকরি পেয়েছেন, মন্ত্রী ও তার বান্ধবীর ঘরে আরো টাকার বান্ডিল ঢুকেছে, আর তারা রাস্তার পাশে প্ল্যাকার্ড ধরে বসে আছেন একদিন ন্যায় পাবেন, এই আশায়। এই দুই ছবির পরতে পরতে রয়েছে অন্যায়ের কাহিনি, দুর্নীতির রমরমার গল্প।
যা বলছিলাম, দুর্নীতির এই নগ্ন রূপ আগে দেখেনি পশ্চিমবঙ্গ। এই লাইনটা লেখার পরই মনে হলো, সত্যিই কি তাই! না কি, দুর্নীতির চিহ্নগুলো আমরা খুব সহজেই উপেক্ষা করেছি। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, এতবড় আকারে দুর্নীতির ছবি এর আগে সামনে আসেনি। কিন্তু ছোটখাট তো এসেছে, আসে। পঞ্চায়েত সদস্য হওয়ার পরই কী করে বিশাল বাড়ি করে ফেলা যায়, তা তো আমরা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে দেখেছি। সিন্ডিকেট, তোলাবাজি-সহ হাজারো উপায়ে দলের নেতারা কীরকমভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছেন, সেটাও তো দেখতে বাকি নেই। পাঁচ বছর পর সাংসদ-বিধায়কদের সম্পত্তি কীরকমভাবে বেড়ে যায়, সেটাও তো আমাদের চোখের সামনে নিয়ে আসছে বেসরকারি সংস্থা এডিআর। হতে পারে, সেখান থেকে ৫০ কোটি পাওয়া যাবে না, রাতভর টাকার বান্ডিল মেশিনে ঢোকাতে হবে না, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা তো লাগবেই!
আসলে আমরা বড় সহজভাবে মেনে নিয়েছি, রাজনীতিকদের কাছে তো দুর্নীতির টাকা থাকবে। বিপদটা এখানেই। তারপরও তো বিনা প্রতিবাদে দুর্নীতিগ্রস্তদেরই জিতিয়ে আনছি। তাহলে কি দায়টা আমাদের উপরেও বর্তায় না? পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় খোলাখুলি কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তখনও তো আমরা সব জেনেবুঝেও চুপচাপ থেকেছি। বরং বিচারপতির বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছি। তার জন্যই তো আজ এই ছবি দেখতে পাচ্ছি আমরা। পার্থ ওঅর্পিতাকে জানাতে হবে, এই সম্পদ তারা কোথা থেকে পেয়েছেন, তেমনই যারা এই অর্থ তাদের দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে সেই সব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, যারা পার্থদের সম্পদ বাড়াতে সাহায্য করেছেন।
তৃণমূলের কিছু নেতা এখন মুখ খুলছেন। কুণাল ঘোষ পার্থের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি করেছেন। যুব নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য টুইট করে বলেছেন, ফোঁড়া যখন পুঁজে ভরে এসেছে, তখন তা ফাটিয়ে দেয়াই শ্রেয়। একটি ফোঁড়ার জন্য গোটা শরীরকে কষ্ট দেয়া বৃথা। সত্যিই কি পরিস্থিতিটা এতই সহজ-সরল? একজনই দুর্নীতি করেছেন? বাকিরা সকলেই সাধু? পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেটরাজ চলে না, বালি মাফিয়ারা সক্রিয় নয়, গুড়-বাতাসা বা ঢাকের চড়াম চড়াম শোনা যায় না? দেবাংশু, আপনি জানেন, একজনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বাকি সবাইকে সাধু প্রতিপন্ন করার সহজ রাস্তাটা সমস্ত রাজনৈতিক দল নিয়ে থাকে। তাতে সাময়িক স্বস্তি থাকে ঠিকই, কিন্তু মূল অসুখ কখনো যায় না। মূল অসুখ সারাতে গেলে নির্মমভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেই সিদ্ধান্ত কি এবার দেখবে পশ্চিমবঙ্গ? বাঁচতে গেলে তো আশা নিয়েই থাকতে হয়। তাই আপাত অসম্ভব জেনেও এই আশাটুকু থাক।