টিআরপি না থাকলে বন্যাও খবর নয়
২৪ জুন ২০২২গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখছে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি৷ আসামের ২৮টি জেলা বন্যার কবলে৷ শুধু আসামেই এখনো পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৭০ জনের৷ ঘর হারিয়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ৷ জলে ভেসে গেছে অন্তত দুই হাজার ৯৩০টি গ্রাম৷
আসাম ছাড়াও অরুণাচল, মেঘালয়, ত্রিপুরাও বন্যায় বিপর্যস্ত৷ বন্যার পাশাপাশি পাহাড়ি অঞ্চলে ধস নামার ফলে বহু এলাকা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট৷ মানুষের কাছে সামান্য ত্রাণটুকুও পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না৷
ভারতের জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি দেখলে উত্তর-পূর্ব ভারতের এই ভয়াবহ অবস্থার সামান্য ইঙ্গিতটুকুও পাওয়া যাবে না৷ গত এক সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমের প্রাইমটাইম জুড়ে থেকেছে অগ্নিপথ নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ এবং মহারাষ্ট্রে সরকার ভাঙার পরিস্থিতি৷ আশ্চর্যের বিষয় হলো মহারাষ্ট্রের বিক্ষুব্ধ বিধায়করা যখন আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে গিয়ে পৌঁছালেন, তখন তাদের পিছন পিছন শয়ে শয়ে সাংবাদিক পৌঁছে গেলেন সেখানে৷ অথচ, বন্যা পরিস্থিতি ক্যামেরা বন্দি করার জন্য গুয়াহাটিতে পৌঁছাতে পারেননি কেউ৷
ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি এমনিতেই মূল ভূখণ্ডের দেশ থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন৷ এর পিছনে ভৌগোলিক কারণ যেমন আছে, তেমনই আছে, মূলস্রোতের ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির সাংস্কৃতিক দূরত্ব৷ সাত দশকেও সেই দূরত্ব কমানো যায়নি, বরং বেড়েছে৷ ভারতীয় মূলস্রোতের গণমাধ্যমে এই দূরত্ব বড় প্রকটভাবে চোখে পড়ছে, যত দিন যাচ্ছে৷ দিল্লি, মুম্বই, কলকাতায় ড্রেনের জল উপচে পড়লেও তা নিয়ে দিনভর পড়ে থাকে গণমাধ্যমগুলি, অথচ উত্তর-পূর্ব নিয়ে কার্যত কোনো খবর নেই৷
সাধারণত দেখা যায়, ভারতীয় রাজনীতিও মূলস্রোতের মিডিয়ার পথই অনুসরণ করে৷ উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে কারও বিশেষ মাথাব্যথা থাকে না৷ এবারেও প্রাথমিকভাবে তা ছিল না৷ তবে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে, মূলস্রোতের রাজনীতি উত্তর-পূর্ব নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার আসামের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে৷ তাদের সাহায্যও পাঠানো হয়েছে৷ আসামের বিজেপি পরিচালিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সম্প্রতি টুইট করে বলেছেন,প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাকে ফোন করে আসামের বন্যা পরিস্থিতির খোঁজখবর নিয়েছেন৷ সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ আসামে কেন্দ্রীয় সাহায্য ঢুকতে শুরু করেছে৷ সেনাও ত্রাণ এবং উদ্ধার কাজে নেমেছে৷
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর নানা দিক আছে৷ এর পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তিও আছে৷ সেই বিতর্কে না ঢুকেও বলা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গুরুত্ব বোঝা যায়৷ আসামের বর্তমান পরিস্থিতি একা রাজ্য সরকারের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়৷ সাধারণত দেখা যায়, এই ধরনের পরিস্থিতিতে কেন্দ্র-রাজ্য বৈরিতাও ঘুঁচে যায়৷ কেন্দ্র সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে৷
আসামে বিজেপির সরকার৷ ফলে সেখানে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের কোনো বৈরিতা নেই৷ কিন্তু অবিজেপি রাজ্যগুলিতেও কেন্দ্র এই ধরনের পরিস্থিতিতে একইভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়৷ এরপরেও 'বঞ্চনা'র প্রশ্ন ওঠে৷ কেন্দ্র প্রতিশ্রুতি মতো সাহায্য করেনি, এমন অভিযোগ ওঠে৷ কিন্তু তা কচিৎ কদাচিৎ৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব এখনো ততটা প্রকট নয়৷
সাধারণত প্রতিটি রাজ্যের হাতেই নিজস্ব দুর্যোগ মোকাবিলা দল এবং তহবিল থাকে৷ কেন্দ্রেরও নিজস্ব তহবিল এবং দল আছে৷ প্রয়োজনে সেই তহবিল রাজ্যের জন্য ব্যয় করে কেন্দ্র৷ কেন্দ্র যে অর্থ সাহায্য করতে পারে, রাজ্যের পক্ষে সেই অর্থ খরচ করা সমস্যার৷ কেন্দ্র রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে দুর্যোগ মোকাবিলা অনেক সহজ হয়ে যায়৷
দীর্ঘদিন ধরে দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়টি সামনে থেকে দেখেছেন সাবেক সরকারি আমলা অমিতাভ রায়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘দুর্যোগ মোকাবিলায় কেন্দ্র-রাজ্য বিতর্ক কখনোই খুব প্রকট হয় না৷ সকলে একসঙ্গে সমস্যার সমাধানের রাস্তা খোঁজে৷’’
আরেক সাবেক আমলা সুমিত দত্ত মজুমদার মনে করেন, এ ধরনের দুর্যোগে কেবল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের কথাই ভাবলে হবে না৷ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরির কথাও ভাবা দরকার৷ উত্তর-পূর্বের যে অঞ্চলে এখন দুর্যোগ পরিস্থিতি, মানচিত্রে সে জায়গুলি দেখলে বোঝা যাবে, ভারতীয় মূল ভূখণ্ড এবং ওই রাজ্যগুলির মাঝখানে বাংলাদেশ ঢুকে আছে৷ ফলে দেশের মধ্যে সড়কপথে ওই অঞ্চলগুলিতে পৌঁছানোর জন্য অনেকটা ঘুরে যেতে হয়৷ যে পথ দিয়ে যেতে হয়, বন্যা এবং ধসে তার অবস্থাও এখন ভয়াবহ৷ সুমিতের বক্তব্য, ওই সমস্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছানোর সবচেয়ে সুবিধাজনক রাস্তা বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে৷ এই পরিস্থিতিতে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবা প্রয়োজন৷ ভারতের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে এবিষয়ে আলোচনা করা৷ অতীতে এনিয়ে সরকার ভাবনাচিন্তা করেছিল বলে জানিয়েছেন তিনি৷ যে প্রকল্পে তিনি নিজেও যুক্ত ছিলেন৷
কথায় বলে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়৷ প্রশাসন এবং সেনা চাইলে ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় গিয়েও ত্রাণের ব্যবস্থা করতে পারে৷ সেই পরিকাঠামো তাদের আছে৷ ইচ্ছে থাকলে সংবাদমাধ্যমও দুর্গমতম এলাকায় গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে আনতে পারে৷ সেই পরিকাঠামো ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলির আছে৷ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির পাশে দাঁড়ানোর সেই সদিচ্ছা কিছুটা হলেও সরকার এবং প্রশাসন দেখিয়েছে৷ এবার সংবাদমাধ্যম সেই পথ অনুসরণ করুক৷ কারণ, সংবাদমাধ্যম সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেয়৷ দুর্যোগের তথ্য দেখলে মানুষ ত্রাণকাজে নেমে পড়া অসংখ্য বেসরকারি সংগঠনকে জিনিস দিয়ে অথবা অর্থ দিয়ে সাহায্য করে৷ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির যে পরিস্থিতি, তাতে সেই অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন এখন অপরিসীম৷