টিউনিশিয়ার সংহতির প্রয়োজন
১৯ মার্চ ২০১৫জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ার অত্যন্ত সঠিকভাবে শব্দচয়ন করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘টিউনিস-এর সন্ত্রাসী হামলা আসলে আমাদের সবার উপর এক কাপুরুষোচিত হামলা, মানবজাতির সাধারণ মূল্যবোধের উপর হামলা৷''
এটা শুধু কোনো দুঃখজনক ঘটনা সম্পর্কে ভেবেচিন্তে বলা এক কূটনৈতিক বিবৃতি নয়, এর পেছনে আরও গভীর সত্য রয়েছে, যাতে হামলাকারীদের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য বোঝা যায়৷ তারা ভেবেচিন্তেই টিউনিশিয়াকে বেছে নিয়েছে৷ মডেল হিসেবে টিউনিশিয়ার সামাজিক ভবিষ্যতের স্বপ্নের উপর হামলা চালানো হয়েছে৷ এই ‘ভিশন' বা স্বপ্ন এমন এক আরব বিশ্বের, যেখানে স্থিতিশীলতা মানেই দমননীতি নয়৷ যেখানে নানা বাধা ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গণতন্ত্র, সুশীল সমাজ, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের সুযোগ রয়েছে৷
স্বপ্নের উপর হামলা
টিউনিশিয়া তথাকথিত ‘আরব বসন্ত'-র মাতৃভুমি হিসেবে পরিচিত৷ গোটা অঞ্চলে এটিই একমাত্র দেশ, যেখানে এই সব মূল্যবোধের কিছু চিহ্ন রয়েছে৷ সে দেশে নরম ইসলামপন্থি ও একাধিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ঘৃণা ও সংঘাতের বদলে সংলাপের পথই বেছে নিয়েছে৷ সুশীল সমাজ অত্যন্ত সক্রিয়৷ অন্যান্য আরব দেশের তুলনায় সে দেশে নাগরিক – বিশেষ করে নারীদের অধিকার প্রায় আদর্শ বলা চলে৷ শুধু সন্ত্রাসবাদী নয়, অঞ্চলের অনেক স্বৈরাচারী শাসকও এমন আদর্শ পছন্দ করে না৷ কারণ এই মডেলের সামনে তাদের নিজস্ব আদর্শ ও সামাজিক ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়ে৷ মিউজিয়ামের উপর হামলা শুধু টিউনিশিয়ার প্রাক-ইসলামি ঐতিহ্যের উপর আঘাত নয়, যেমনটা ব়্যাডিকাল সালাফি ও জিহাদিরা সিরিয়া ও ইরাকে করে চলেছে৷ আজকের টিউনিশিয়াকে তারা পশ্চিমা জগতের ‘আদরের সন্তান' বলে মনে করে৷ তাই সে দেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ন্যায্য বলে তারা মনে করে৷ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে টিউনিশিয়া গোটা অঞ্চলে সাফল্যের এক মডেল হয়ে উঠুক – যে কোনো মূল্যে তারা এমন সম্ভাবনা রুখতে চায়৷
টিউনিসের জাতীয় মিউজিয়ামের উপর হামলা সে দেশের উন্নয়নের পথে হুমকি হয়ে উঠছে৷ এই ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, উত্তর আফ্রিকার ছোট এই দেশটিকে কীভাবে অসংখ্য সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জ সামলাতে হচ্ছে৷ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়৷ টিউনিসে হামলার পর সে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন ক্ষেত্র আরও ক্ষতির মুখ দেখবে, এটা ধরে নেওয়া যায়৷ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের মাত্রাও অত্যন্ত বেশি৷ অনেক তরুণ-তরুণী দেশের মধ্যে নিজেদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না৷ অনেকে বে-আইনি পথে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছে৷ অনেকে আবার আদর্শ অথবা মোটা টাকার লোভে সিরিয়া অথবা ইরাকে জিহাদের দলে নাম লেখাতে যাচ্ছে৷ অন্য কোনো আরব দেশ থেকে এত শতাংশ মানুষ ‘ইসলামিক স্টেট' সহ অন্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দলে নাম লেখাচ্ছে না, যেমনটা টিউনিশিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে৷ দেশের মধ্যেও, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় অনেক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে৷
পশ্চিমা বিশ্বের ‘আদরের সন্তান'
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ‘‘এই হামলা আমাদের সবার উপর'' হয়েছে, তখন তিনি হয়ত বলতে চান, ইউরোপীয় পররাষ্ট্র ও উন্নয়ন সাহায্য নীতিও এই হামলার লক্ষ্য ছিল৷ এই নীতি গণতান্ত্রিক সুশিল সমাজ হিসেবে টিউনিশিয়ার বিকাশকে বড় মাত্রায় সাহায্য করেছে৷ তিনি এটাও বলতে পারতেন, ‘‘আমরা সবাই টিউনিশিয়া'', যেমন আমরা সবাই ‘জ্য সুই শার্লি' বলে উঠেছিলাম৷ সারা বিশ্বে যারা হিংসার শিকার হচ্ছে, তাদের প্রতি আমাদের যেমনভাবে সংহতি দেখানো উচিত৷
তবে শুধু কথায় কাজ হবে না৷ টিউনিশিয়ার আরও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সে দেশের নাগরিক সমাজকে সাহায্য করার প্রয়োজন আছে৷ নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রেও আরও স্পষ্ট সাহায্য চাই – তাতে যতই ঝুঁকি থাকুক না কেন৷ আরব বিশ্ব থেকেও আরও সহায়তার প্রয়োজন আছে৷ কারণ টিউনিশিয়ার স্বপ্ন মোটেই ‘পশ্চিমা' নয়৷ এই স্বপ্ন গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আরব-ইসলামি ভাবধারা ভিত্তিক যুগোপযোগী এক মেলবন্ধন৷ এমন লক্ষ্যের জন্য সংগ্রাম সত্যি সার্থক৷