ডিজিটাল ট্রেনের ‘অ্যানালগ' সেবা
৪ অক্টোবর ২০১৯রেলগাড়ি নিয়ে হয়তো সবচেয়ে রোমান্টিক কবিতাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই লিখেছেন৷ ‘হঠাৎ দেখা' কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন৷ রবিঠাকুরের রেল গাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখার অনুভূতি বাঙালি পাঠাকদের যৌবনে বারবার রেলগাড়ির দিকে টেনে নেয়৷ বারবার মনে হয় যদি তার দেখা পাই! কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন৷ রেলের কামরায় এখন থাকে শুধু ‘আলুর দম' হওয়ার অভিজ্ঞতা৷ ভিড় সামলে, শিডিউল মিলিয়ে, টিকেট কেটে তারপর কামরায় ঢুকে সিট না পেয়ে রোমান্টিকতা হারিয়ে যায়৷ রোমান্টিক নিরবতায় ‘কালো রেশমের' কাপড়ে সেই প্রিয়জনকে দেখার সুযোগ আর হয় না৷
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রেলের দুর্নীতির ১০টি উৎস চিহ্নিত করেছে৷ তার মধ্যে তিনটি হলো রেলের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রিতে ব্যাপক কালোবাজারি, যাত্রীবাহী ট্রেন ইজারা দেয়া এবং ট্রেনে নিম্নমানের খাবার দিয়ে বেশি দাম নেয়া৷ এই তিনটি বিষয় দিয়েই যাত্রীসেবার মান কেমন তা অনেকটা বোঝা যায়৷
একজন যাত্রীর অভিজ্ঞতা শোনা যাক৷ নাম মো. আজমল হোসেন৷ তাঁর বাড়ি উত্তরবঙ্গে৷ তিনি প্রায় নিয়মিতই ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করেন৷ তিনি জানান, ‘‘প্রথম সমস্যা হলো টিকিট পাওয়া যায় না৷ ব্ল্যাকে বিক্রি হয়৷ আমরা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাই না৷ কিন্তু ব্ল্যাকার ঠিকই পায়৷ আবার ই-টিকেট করলে চারটির বেশি পাওয়া যায় না৷ তাই পরিবারের সবাই একসঙ্গে গেলে সমস্যা৷ ট্রেনের সিট, দরজা, জানালা অনেক সময় ভাঙা থাকে৷ আসনের চেয়ে বেশি টিকিট দেয়া হয়৷ ফলে গাদাগাদি অবস্থা থাকে৷ টিকিট কেটেও অনেক সময় বসার আসন পাওয়া যায় না৷ আর বেশিরভাগ সময়ই ট্রেন ছাড়তে দেরি করে৷ ফলে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না৷ ট্রেনের খাবার-দাবার নিম্ন মানের৷ দাম রাখা হয় অনেক বেশি৷ খাবারে তেলাপোকা বা পোকামাকড় পাওয়ারও অভিজ্ঞতা আছে৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘বাইরে থেকে ট্রেনে পাথর ছোঁড়া, ট্রেনের লাইনের নাট বোল্ট খুলে যাওয়া, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, বগি খুলে যাওয়ার মতো ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হতে হয় আমাদের৷ আসলে ডিজিটাল ট্রেন চলে অ্যানালগ মোডে৷ ঠিক সময় গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না৷ ৮০ কি.মি. গতি থাকার কথা, কিন্তু সর্বোচচ ৫০ কি.মি. গতিতে চলে৷ যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে পারে না৷''
তাঁর মতে, ‘‘ কোরবানীর ঈদের মতো উৎসবের সময় ট্রেনে কোনো নিয়মই মানা হয় না৷ যত সিট তার কয়েকগুণ বেশি টিকেট দিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়৷ ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যান কেউ কেউ৷ আর ভিতরে পুরো আলুরদম অবস্থা৷''
গত জুনে প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত হকারের চাপ, পকেটমারদের দৌরাত্ম, খাবার গাড়ি নিয়ে সিন্ডিকেট, টিকিট কালোবাজারি, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, পুরোনো বগি দিয়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাত্রী সেবাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে৷ তাছাড়া ছেড়ে যাওয়ার পর ট্রেনের ইঞ্জিন প্রায়ই বিকল হয়ে যায়৷
ট্রেনের সেবার মান না বাড়লেও টিকিটের দাম বাড়ছে দফায় দফায়৷ ট্রেনের যাত্রী সেবার মান খারাপের পিছনে প্রধান কারণ দুর্নীতি৷ ট্রেনের দুর্নীতির যে ১০ খাত চিহ্নিত করা হয়েছে তার ৩টির কথা শুরুতেই বলা হয়েছে৷ আরো যা আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো: ১. রেলের সম্পত্তি লিজ ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ২. লোকোমোটিভ, কোচ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ক্রয় ও সংগ্রহে দুর্নীতি ৩. সিগনালিং ব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিকায়নে দুর্নীতি ৪. ডাবল ও সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ কাজে দুর্নীতি ৫. রেলের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি ৬. রেলের কারখানা সংস্কার, যন্ত্রাংশ বিক্রয় ও সংস্থাপনে দুর্নীতি এবং ৭. ওয়ার্কশপ ও স্লিপার ফ্যাক্টরি কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে দুর্নীতি৷
ব্রিটিশ আমল থেকে ধরলে বাংলাদেশে রেলের ইতিহাস দেড়শ' বছরেরও বেশি সময়ের৷ মজার ব্যাপার হলো, রেলের প্রতি যাত্রীদের একদিকে আগ্রহ বাড়ছে, অন্যদিকে সেবার মানের উন্নতি হচ্ছে না এবং লোকসান বাড়ছে৷ ২০১৭ সালের তুলনায় ১০১৮ সালে রেলের যাত্রী বেড়েছে এক কোটিরও বেশি৷ অথচ ২০১৭ সালে রেলের লোকশান এক হাজার ২০০ কোটি এবং ২০১৮ সালে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা৷ দেশে তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ আছে৷ এর ৭৫ ভাগই মানসম্পন্ন নয়৷
বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৭৮টি লোকোমোটিভ, এক হাজার ৬৫৬টি মিটারগেজ ও ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ এবং ৮ হাজার ৬৮০টি পণ্যবাহী ওয়াগন আছে৷ সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষন না করায় অধিকাংশের অবস্থাই জরাজীর্ন৷
রেলের যাত্রীসেবার অবস্থা এবং এর উন্নয়ন নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে চাননি রেল সচিব মোফাজ্জল হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রতিনিয়তই যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের চেষ্টা করছি৷ অবকাঠামো এবং সেবা দুই দিকেই কাজ হচ্ছে৷ আমাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে যাত্রীসেবার মান উন্নয়ন করা৷''
এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের টিমেও আছেন তিনি৷ জানা গেছে, রেলের উন্নয়নে ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে৷ সচিব বলেন, ‘‘ঢাকা থেকে কলকাতা এবং খুলনা থেকে কলকাতা যে মৈত্রী এবং বন্ধন ট্রেন সার্ভিস আছে, এটা চারদিন চলে৷ আমরা ছয়দিন করার জন্য ভারতের সাথে আলোচনা করছি৷''
হারুন উর রশীদ স্বপনের এই প্রতিবেদনটি আপনার কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷