ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম মামলা
১২ অক্টোবর ২০১৮মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি৷ তাদের বিরুদ্ধেই প্রথম এই মামলাটি হলো৷ গ্রেপ্তারকৃতদের দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে৷
তিনজন মন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকার পরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাস হওয়ায় হতাশ সম্পাদক পরিষদ৷ শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে পরিষদের পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে বাকস্বাধীনতা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের সুরক্ষায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করবেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই আইনটা বড়ই উদ্বেগের৷ ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলেও এই আইন হয়নি৷ এখন বাংলাদেশে এমন একটি আইন হবে তা তো আমি চিন্তাও করতে পারি না৷ আইনের চিন্তা করে তো আর লেখালেখি করা যায় না৷ আমরা তো পত্র-পত্রিকায় লেখি, বিভিন্ন জার্নালে লেখি, এখন এই লেখালেখি কার বিরুদ্ধে যাবে আর কে মামলা ঠুকে দেবে এই চিন্তা করে তো লেখা যাবে না৷ সাংবাদিকদের জন্য তো বিভিন্ন সংগঠন আছে, তারা কথা বলছেন৷ কিন্তু যাঁরা বিচ্ছিন্নভাবে লেখালেখি করেন, তাঁদের পক্ষে কে কথা বলবে?’’ দুই কোটির বেশি মানুষ ফেসবুকে সম্পৃক্ত, তাঁরাও তো নিয়মিত লেখালেখি করেন৷ এখন তাদের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত হবে? অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য সরকার আইন করেনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এ কারণেই তো বলছি, আইনটি সবার জন্যই উদ্বেগের৷’’
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি৷ এরপর তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে পুলিশ৷ গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন কাওসার গাজী, সোহেল মিয়া, তরিকুল ইসলাম শোভন, রুবাইয়াত তানভির আদিত্য ও মাসুদুর রহমান ইমন৷ পরে তাদের ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে পুলিশ৷ আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন৷
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম মামলা৷ গ্রেফতারকৃতরা ফেসবুকের মাধ্যমে প্রশ্ন একশ' ভাগ কমনের নিশ্চয়তা দিয়ে বিকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছিল৷ তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৩, ২৪ ও ২৬ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছে৷ সে কারণেই তাদের বিরুদ্ধে এই মামলা হয়েছে৷’’
গ্রেফতারকৃতরা নতুন এই আইনটি সম্পর্কে জানে কিনা- জানতে চাইলে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা ধরেই নেই যার বয়স ১৮ বছরের বেশি তারা বাংলাদেশের সব আইন সম্পর্কে জানেন৷ কেউ জেনে অপরাধ করেন, কেউ না জেনে অপরাধ করেন৷ অপরাধ যেভাবেই হোক না কেন, সেটা অপরাধই৷’’
পাঁচ প্রতারকের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার এই আইনে প্রথম মামলাটি দায়েরের পর প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁর ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘এই ধরনের অপরাধ প্রতিরোধের জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন৷ এই আইনটি ছাড়া এমন অনলাইন প্রতারণার ঘটনাগুলোর বিচার করা অসম্ভব৷’’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের আগে থেকে এর সমালোচনা চলছে৷ সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা দাবি করছেন, এর কয়েকটি ধারা মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করবে৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, ইন্টারনেটে মানুষের বিচরণ সুরক্ষিত করতে এই আইনটি করা হয়েছে৷
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুরু থেকেই আমরা মানবাধিকার কর্মীরা এই আইনটি পর্যবেক্ষন করে আসছি৷ এর বেশ কয়েকটি ধারা স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য হুমকি৷ আইনের যেমন প্রয়োগ হয়, অপপ্রয়োগও হয়৷ এখন আইনের অপপ্রয়োগের ফলে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাকে রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ কিভাবে দেবে? সাংবাদিকদের পক্ষে তো নানা ধরনের সংগঠন আছে, সম্পাদক পরিষদ আছে, সাংবাদিকদের বিভিন্ন ইউনিয়ন আছে তাঁরা কথা বলছে, ভবিষ্যতেও বলতে পারবে, কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন কিছু লিখে বিপদে পড়বে, তার পক্ষে কে দাঁড়াবে? তিনি তো নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন৷ ফলে আমার মনে হচ্ছে, সাংবাদিকদের চেয়েও স্বাধীন লেখকদের বিপদ বেশি৷’’
এদিকে শিগগির শুরু হতে যাওয়া বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ সংশোধনের দাবি জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ৷ বৃহস্পতিবার পরিষদের এক সভা শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়৷ বিবৃতিতে এ আইনের একটি সংশোধিত খসড়া প্রণয়নের ব্যাপারে তিনজন মন্ত্রীর দেওয়া সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হওয়ায় গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ৷
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে সম্পাদক পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ সভায় বলা হয়, সাইবার স্পেস ও ডিজিটাল নিরাপত্তায় আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা সম্পাদক পরিষদ সমর্থন করে৷ তবে সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩-এর মতো বিতর্কিত ধারাগুলোকে মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পরিপন্থী, বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ৷
বিবৃতিতে বলা হয়, সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগের কথা মন্ত্রিসভায় উত্থাপন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি সংশোধিত খসড়া প্রণয়নের ব্যাপারে তিনজন মন্ত্রীর দেওয়া সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হওয়ায় সম্পাদক পরিষদ গভীর হতাশা প্রকাশ করছে৷ সম্পাদক পরিষদ বিষয়টিকে তিনজন সিনিয়র মন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে সংগঠনের আস্থা ও বিশ্বাসের লঙ্ঘন মনে করে৷ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর উদ্যোগে সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ তিনি প্রস্তাবিত আইন নিয়ে নতুন এক দফা আলোচনা শুরুর প্রতিশ্রুতিও দেন৷ একই প্রতিশ্রুতি ওই সভায় আইনমন্ত্রী এবং আইসিটি মন্ত্রীর পক্ষ থেকেও দেওয়া হয়েছিল৷