1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে ডিজিটাল স্টার্টআপ

২০ জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশে প্রযু্ক্তি নির্ভর ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছেন তরুণরা৷ অনেকেই ভালো করছেন, অনেকে ঝরেও পড়ছেন৷ উদ্যোক্তারা ভবিষ্যতে এই শিল্পকে বড় করে গড়ে তুলতে চান৷ তাঁদের কথায়, সেই মেধা ও দক্ষতা তাঁদের আছে৷ তবে আরো পরিশ্রম করতে হবে৷

https://p.dw.com/p/2grX0
Symbolbild Mobilität mit Smartphone-Unterstützung
ছবি: Fotolia/Syda Productions

একটি স্বনামধন্য টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করেন মেহেফুজুল হাসান সজীব৷ অফিস বনানীতে৷ তিনি থাকেন কেরানীগঞ্জে৷ একটা সময় এতদূর অফিসে আসতে বেশ বেগ পেতে হতো৷ সময় লাগত অনেক৷ একাধিকবার বাস বা টেম্পো বদল করতে হতো৷ ঠিক এমন সময় এক বন্ধু তাঁকে একটি বাইক সার্ভিসের কথা বলেন, যার সেবা পেতে একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়৷ একটি প্রোমোশনাল কোডও দেন সেই বন্ধু, যাতে একটি ফ্রি রাইডও পান সজীব৷ প্রথম দিনের সার্ভিসেই খুশি সজীব৷ আগে যেখানে মাঝে মাঝে  দেড়-দুই ঘণ্টাও লেগে যেত, এখন ৩০ থেকে ৪০ মিনিটেই অফিসে পৌঁছে যাচ্ছেন৷ এরপর থেকে নিয়মিতই ‘পাঠাও' নামের এই সেবাটি গ্রহণ করছেন তিনি৷ ‘‘ঢাকায় যে জ্যাম এখন, এটা অনেকটা বিপদ থেকে বাঁচায়৷ তাছাড়া রাইডাররাও অনেক স্মার্ট৷ তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে করতে আসা যায়'', বলছিলেন সজীব৷

সজীবের মতো এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই৷ আর তাই খুব অল্প সময়ে গ্রাহকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে ‘পাঠাও'৷ এ বিষয়ে ডয়চে ভেলে কথা বলেছে ‘পাঠাও'-এর তরুণ সিইও হুসেইন ইলিয়াসের সঙ্গে৷ তিনি জানালেন, শুরুটা পার্সেল ডেলিভারি দিয়ে হলেও পরবর্তীতে মানুষকে রাইড সেবা দিয়ে বেশ সাড়া পেয়েছেন৷ প্রথমদিকে মুখে মুখে ছড়ায় তাঁর এই অ্যাপভিত্তিক সেবা৷ ‘‘প্রথম দিকে এটি ছিল অন ডিমান্ড পার্সেল ডেলিভারি৷ কিন্তু সেটি সফল হচ্ছিল না৷ পরে আমরা ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য ডেলিভারি দেয়া শুরু করলাম৷ তখন সেটি চলছিল৷ পরবর্তীতে ২০১৬ সালের নভেম্বরে আমরা অন ডিমান্ড প্রডাক্টের বদলে অন ডিমান্ড রাইড চালু করি৷''

‘প্রথম দিকে সফল হচ্ছিলাম না’

চালু হবার পর এ পর্যন্ত ২ লাখ মানুষ ‘পাঠাও' ডাউনলোড করেছেন৷ এছাড়া, নিজের বাইক দিয়ে এই অ্যাপভিত্তিক প্লাটফর্মের মাধ্যমে সেবা দিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার জন ডাউনলোড করেছেন ‘পাঠাও'-এর ড্রাইভার অ্যাপ৷ এরই মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে একই রকমের সেবা দেয়া আন্তর্জাতিক কোম্পানি ‘উবার' বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে৷ এদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো কিছু অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে৷ ‘পাঠাও'-এর সিইও হুসেইন ইলিয়াস বললেন, ‘‘ব্যক্তিগত গাড়ি বা বাইক দিয়ে সেবা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে কোনো নীতিমালা বাংলাদেশে আগে ছিল না৷ মোটর পরিবহন আইন ১৯৮৭ যখন করা হয়েছিল তখন কেউ চিন্তা করেনি যে, ব্যক্তিগত মোটরবাইক কমার্শিয়ালি ব্যবহার করা যায়৷ কিন্তু সরকার আমাদের সহযোগিতা করেছে৷ আমরা আমাদের সেবা চালিয়ে যেতে পেরেছি৷ এখন তারা একটি রেগুলেশন করতে যাচ্ছে, যা ইতিবাচক৷ ''

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও একটা জোয়ারের মতোই এসেছে ডিজিটাল স্টার্টআপ৷ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খুব ভালোও করছে৷ বিশেষ করে ই-কমার্স ও সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিডিজবস ডটকম, বাগডুম ডটকম, পাঠাও, এসো ডটকম, রকমারি ডটকম, চালডাল ডটকম, প্রিয়শপ ডটকম, আইটি বাজারবিডি, হাংরিনাকি ডটকম, সিন্দাবাদ ডটকম, চলো ডটকম, ডক্টরোলা, থার্ডবেল, বন্ডস্টেইন, টিম ইঞ্জিনসহ অনেক নতুন পুরোনো প্রতিষ্ঠানের নাম শোনা যাচ্ছে৷ বিশেষ করে লাইফ স্টাইলভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এতটাই জনপ্রিয় যে, অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পাতাতেও হাজারো নেটিজেনের ভিড় লেগেই থাকে৷

‘প্রেস্ক্রিপশন ভুল পড়ে রোগী যেন অকালে প্রাণ না হারান’

সম্প্রতি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি)-র হিসেব দেখাচ্ছে, গেল এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত কোটি ছাড়িয়েছে৷ ৩১ মে পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট গ্রাহক ৭ কোটি ২০ লাখ এবং এদের ৯৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ গ্রাহক মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে৷ এছাড়া ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) এবং ০ দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রাহক ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের গ্রাহক৷ ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি ৫০ লাখ৷ এর অর্থ, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বড় অংশটিই তাদের মোবাইলের মাধ্যমে তা ব্যবহার করেন৷

ইন্টারনেট ও মোবাইল অ্যাপনির্ভর এ সব ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোর সম্ভাবনা বেশ ভালো৷ আর তাই তরুণ উদ্যোক্তারাও আসছেন নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে৷ খাত ও পেশাভিত্তিক আইডিয়া নিয়েও কাজ হচ্ছে৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বিনোদনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্মে কাজ করছেন৷

তেমনই একটি ইজিপ্রেস ডটকম, যা এরই মধ্যে দেশীয় গণমাধ্যমের নজর কেড়েছে৷ ডাক্তারদের সহযোগিতা করতে তৈরি এই সফটওয়্যারটি মূলত রোগী ও চিকিৎসা ম্যানেজমেন্টের সুবিধার্থে তৈরি করা৷ এতে বাংলাদেশের সব কোম্পানির সব ওষুধের নাম আছে৷ তাই নতুন করে ডাক্তারকে সব ওষুধের নাম যেমন মনে রাখতে হবে না, তেমনি তিনি যে কোনো রোগীর পুরো ট্র্যাকরেকর্ড রাখতে পারবেন এর মাধ্যমে৷ ইজিপ্রেস ডটকম-এর সিইও জুবায়ের আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘দেশে মোট রোগীর তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা অপ্রতুল৷ তাই ডাক্তারকে অনেক রোগী অত্যন্ত কম সময়ে দেখতে হয়৷ এর ফলে তিনি খুব দ্রুত প্রেস্ক্রিপশন লেখেন, যা সবার জন্য পাঠ করা সম্ভব হয় না৷ ফার্মেসিগুলোও অনেক সময়ই ভুল পড়ে ভুল ওষুধ দেয়৷ প্রেস্ক্রিপশনের এই ভুলের কারণে বছরে প্রায় হাজার খানেক রোগী অকালে প্রাণ হারায়, যার প্রেক্ষিতে মাননীয় হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন যে, ডাক্তারদেরকে বড় হরফে অথবা সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রেস্ক্রিপশন লিখতে হবে৷ ডাক্তারদের সহযোগিতা করার চেষ্টা থেকেই এই উদ্যোগ৷'' সফটওয়্যারটি শুরু করার মাত্র তিন দিনেই প্রথম মাসের টার্গেট পূরণ হয়ে গেছে বলে জানালেন তিনি৷

‘স্রোতে গা ভাসানো উচিত নয়’

বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও ডিজিটাল স্টার্টআপ করে সবাই যে সাড়া পাচ্ছেন বা ভালো করছেন, এমন নয়৷ পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বেই সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ স্টার্টআপ সফল হয়৷ তাই এ দেশে জোয়ার এসেছে বলে সবাইকে জোয়ারে গা ভাসাতে হবে – এমন মনে করেন না বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রাসেল টি আহমেদ৷ ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই না ভেবে, না জেনে স্টার্টআপ খুলে বসছে, পরে সফলতা না পেয়ে হতাশ হচ্ছে৷'' তাঁর মতে, একজন তরুণ বা নতুন উদ্যোক্তা যা করতে চান, তার সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকতে হবে এবং ব্যবসা বুঝতে হবে৷ ‘‘সারা বিশ্বে এবং আমাদের দেশেও স্টার্ট আপ ইভেন্ট ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে৷ আমরা বেসিস ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও ইভেন্ট করেছি৷ এতে দেখা যায়, একটা বিশ্ববিদ্যালয় সদ্য পাশ হওয়া তরুণের মাথায় একটা কিছু এলে তা নিয়ে চলে আসে৷ এ সম্পর্কে তার যথাযথ জ্ঞান না থাকায় এবং ব্যবসা না বুঝতে পারায় ব্যর্থ হয়৷ কেউ যখন স্রোতে গা ভাসিয়ে স্টার্ট আপ করতে যায়, সেক্ষেত্রে তার ব্যর্থ হবার আশঙ্কা অনেক বেশি৷''

ইজিপ্রেসের জুবায়ের আহমেদের মতে, বাংলাদেশে ডিজিটাল স্টার্টআপ করার ব্যাপারে সরকার অনেক কিছুই করেছে৷ কিন্তু তারপরও অনেক চ্যালেঞ্জ এখনো অতিক্রম করা যায়নি৷ ‘‘অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে, যেমন ইন্টারনেট দুর্বল৷ ডিজিটাল খাতে বিনিয়োগ আরেকটি সমস্যা৷ তাছাড়া সরকারের  পক্ষ থেকে যা যা বলা হয় তার সবটুকু করা হয় না৷''

এ বিষয়ে রাসল টি আহমেদ বলেন, শুধু আইডিয়ার ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগ আকর্ষণ করার মতো অবস্থা এখনো বাংলাদেশে তৈরি হয়নি৷ আর ব্যবসা করতে হলে সবকিছু সরকার করে দেবে– এমন ভাবারও কিছু নেই বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘অবকাঠামো একটি চলমান বিষয়৷ একসময় শুধু ডায়াল আপ কানেকশন ছিল, সেখান থেকে টু-জি, থ্রি-জি এসব হয়েছে৷ তো ইন্টারনেট সেবা অবকাঠামো উন্নয়ন চলতে থাকবে৷''

তিনি মনে করেন, সরকারের কাজ নীতিনির্ধারণী জায়গায়৷ ‘‘সরকার এমন ফ্রেমওয়ার্ক করবে যেখানে যারা বিনিয়োগকারী, সে দেশি বা বিদেশি হোক, তার জন্য সেই পরিবেশ আছে কিনা এবং সেই ইনভেস্টমেন্ট সে তুলে নিয়ে যেতে পারবে কিনা৷ এছাড়া, কেউ কেন আপনার ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে? বিনিয়োগ করতে হলে আগে আপনাকে তো প্রমাণ করে দেখাতে হবে৷''

এই সংগঠক ও উদ্যোক্তা মনে করেন, ব্যাংকগুলোও এ খাতে রিস্ক ফাইন্যান্সিং করতে চায় না৷ তাই বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সরকার ও বেসিস কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি৷ ‘‘আমাদের ব্যাংকগুলো ট্র্যাডিশনাল মডেলে চলে৷ আমাদেরকে কিছু সফল স্টার্টআপ করে দেখাতে হবে৷ তাহলেই ব্যাংকগুলো ও অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবে৷ বেসিস-এর পক্ষ থেকে আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করছি৷''

তবে ইভেন্টভিত্তিক না থেকে স্টার্টআপ সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যথাযথ তথ্য তুলে ধরা বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘আপনি যখন স্টার্টআপ করবেন, তখন কো-ফাউন্ডার কাকে নিচ্ছেন, কতদিনে ব্রেক ইভেনে যাবেন তার পরিকল্পনা আছে কিনা, থাকলে সেটি কী, এসব বিষয়ে নতুনদের জানাতে হবে৷ এছাড়া রেগুলেশনের জায়গা থেকে সরকারের আরেকটি বিষয় করা উচিত তা হল, রেসিডেন্সিয়াল স্পেসে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া৷ কমার্শিয়াল স্পেস অনেক ব্যয়বহুল৷ তাই এ ধরণের ব্যবসা শুরুতেই মাঠে মারা যাবে৷ আমরা সময়ে সময়ে সরকারের সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি৷''

এই উদ্যোক্তারা মনে করছেন, নতুন লাইসেন্স করা থেকে শুরু করে এই ব্যবসায় বিভিন্ন স্তরে এখনো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যেগুলো অতিক্রম করতে সবার সহযোগিতা দরকার৷ তবে ডিজিটাল স্টার্টআপের ভবিষ্যত নিয়ে তরুণ উদ্যোক্তা ও সংগঠকরা আশাবাদী৷ তাঁরা মনে করছেন, সুড়ঙ্গের ওপারে অনেক আলো আছে৷ এই খাত বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে৷ তবে সেজন্য উদ্যোক্তাদের পড়াশোনা করতে হবে এবং প্রচুর শ্রম দিতে হবে৷