1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঢাকায় এলএসডি বিক্রিতে ১৫টি দল

৩১ মে ২০২১

হঠাৎ করেই বাংলাদেশে এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড) নামক একটি মাদক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এই মাদক বিক্রি ও সেবনের অভিযোগে আটজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

https://p.dw.com/p/3uEGk
SYmbolbild | Drogen
প্রতীকী ছবিছবি: Paul Faith/empics/picture alliance

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এই মাদক সেবনের পর নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেছেন। ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা এই মাদকের বিষয়টি জানতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মাদকের সবচেয়ে খারাপ দিক হল এটা এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে। ফলে এটা সেবনের পর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন একজন মানুষ যা খুশি তাই করতে পারেন। এমনকি উঁচু ভবন থেকে লাফ দিতেও দ্বিধা করে না।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সব মাদকই  ক্ষতিকর। কিন্তু এলএসডির সবচেয়ে খারাপ দিক হল এটা সেবনের ফলে দৃষ্টি বিভ্রম বা হেলুসিনেশন হয়ে থাকে। এখন কেউ যদি খুব খুশিতে থেকে এই ড্রাগ নেয় তাহলে তার মধ্যে রঙিন চিন্তা আসে। আর কেউ যদি খারাপ অবস্থার মধ্যে থেকে এই ড্রাগ নেয় তাহলে খারাপ জিনিসগুলো তাকে ভর করে। সে তখন যা খুশি তাই করতে পারে। এমনকি আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারে, উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে। ফলে এটা সরবরাহের রুটটা আগে বন্ধ করতে হবে। এটা অন্য মাদকের চেয়ে দামি। যারা নিয়মিত মাদক সেবন করে তারা সবসময়ই নতুন নতুন মাদক খোঁজেন। এই মাদকের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশি সম্পৃক্ততা দেখছি আমরা। এটি কোনভাবেই যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে খেয়াল করতে হবে।”

ডা. তাজুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আলোচনায় এলএসডি

২০১৯ সালে এই মাদকটি বাংলাদেশে ধরা পড়লেও খুব একটা আলোচনায় আসেনি। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর এই মাদকটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। গত ১৫ মে রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কাটতে থাকেন হাফিজুর। আর বলছিলেন- "আমাকে মাফ করে দাও”। তখন হাফিজুর মারা গেলেও তার পরিচয় শনাক্ত হয়নি। আট দিন পর ঢাকা মেডিকেল মর্গে তার লাশ সনাক্ত করে পরিবার।

ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবির দায়িত্বে) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছাত্র হঠাৎ করে কেন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলায় চালাল, সেটা তদন্ত করতে গিয়েই আমরা এই মাদকটির সন্ধান পাই। তখন আমরা হাফিজুরের তিন বন্ধু সাদমান সাকিব রূপল (২৫), আসহাব ওয়াদুদ তূর্য (২২) ও আদিব আশরাফকে (২৩) ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করি। এরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের কাছ থেকে এলএসডি পাওয়া যায়।”

জিজ্ঞাসাবাদে হাফিজুরের বন্ধুদের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে এই পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, হাফিজুর ঈদের পরদিন ঢাকায় ফেরার পর সন্ধ্যায় এক প্রতিবন্ধী রিক্সাচালকের সঙ্গে ‘বাজে আচরণ করেছিলেন'। এরপর তারা কার্জন হল এলাকায় ‘নেশা করতে বসে'। এলএসডি গ্রহণের পর বন্ধুদের একজন হাফিজুরকে বলেন, মামা তুমি কাজটা ভালো করনি। এরপর হাফিজুর কার্জন হলের মাঠ থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। বন্ধুরা একবার সেখান থেকে ধরে এনেছিল। এরপর তিনি আবার বেরিয়ে যান। কয়েকজন রিকশাচালকের পা চেপে ধরে বলেন, আমাকে মাফ করে দাও। এরপরই তিনি ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। হাফিজুরের অবস্থা দেখে ভয়ে কাউকে কিছু না বলে বন্ধুরা পালিয়ে যায়।

হাবিবুর রহমান

হাফিজুরের বড় ভাই হাবিবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার ভাই যে এই ধরনের কোন মাদকে আসক্ত ছিল আমরা সেটার কিছুই জানতাম না। আমাদের  ব্রাহ্মনবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামের বাড়ি থেকে ঈদের পরদিন হাফিজুর গেল তখনও আমাদের কোন সন্দেহ হয়নি। আর ডিবি কিন্তু বলেনি, ও মাদকাসক্ত ছিল। কেউ ওকে জোর করে এই মাদক দিয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে এই মাদক সেবনের পর যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা তেমনটাই হয়েছে। আমরা আশা করছি, ডিবি বিষয়টির তদন্ত করছে, সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসে।”

ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, টেলিগ্রাম অ্যাপ এ যোগাযোগ করে প্রতি ব্লট এলএসডি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা খরচ করে নেদারল্যান্ডসের এক ব্যক্তির কাছ থেকে পার্সেল সার্ভিসের মাধ্যমে ওই মাদকগুলো দেশে এনেছে। প্রতি ব্লট তারা তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি করে। মাদক বিক্রির জন্য তাদের দুটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। একটির নাম "আপনার আব্বা”। আরেকটি নাম "বেটার ব্রাউনি এন্ড বিয়ন্ড”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র হাফিজুর রহমান ছিলেন একজন মূকাভিনয় শিল্পী। টিএসসিভিত্তিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় "মাইম অ্যাকশনে”র সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

দেশে প্রথম কবে ধরা পড়ে এই মাদক

এলএসডির ভয়াবহতা বিবেচনায় ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এটাকে নিষিদ্ধ মাদকের তালিকায় রাখা হয়। জাতিসংঘও ১৯৭১ সালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এলএসডি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মেহেদী হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের একটি বাড়ি থেকে এলএসডির ২৫টি স্ট্রিপ (ব্লট) এবং ৫ মিলিলিটার তরল এলএসডি উদ্ধার করা হয়। ওই সময় আমরা ইয়াসের রিদওয়ান আনান (২১) এবং সৈয়দ আহনাফ আতিফ মাহমুদ (২১) নামে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে গ্রেফতার করি। অনলাইনে মাদক বেচাকেনার তথ্য পেয়ে ক্রেতা সেজে আমরা ওই অভিযানটি চালিয়েছিলাম। ইয়াসের রিদওয়ান কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেখান থেকে তিনি তেলের বোতলে ভরে তরল এলএসডি এবং ডাক টিকেটের মত দেখতে এলএসডি স্ট্রিপ নিয়ে আসেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছিলেন, কানাডায় পড়তে যাওয়ার আগে থেকেই তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। দেশেও তিনি এলএসডি সেবন করেছিলেন।

মেহেদী হাসান বলেন, তখন চক্রে নারীরাও যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া ইয়াসেরদের কাছ থেকে তখন জানা যায়, তাদের জন্য আরেকটি চালান নিয়ে আসছেন কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আরেক বাংলাদেশি ছাত্র। ওই ছাত্রের ভ্রমণ তারিখ, টিকিট সংক্রান্ত তথ্যও যোগাড় করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর তিনি দেশে আসেননি। তখন ওই দুজন জিজ্ঞাসাবাদে বলেছিলেন, তারা অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে এলএসডির ওই চালানটি দেশে আনেন। দেশের বিভিন্ন পার্টিতে উচ্চবিত্ত তরুণেরা এলএসডি নিতেন। এইসব তরুণদের অনেকেই দেশের বাইরে লেখাপড়া করেন। ওই ঘটনার পর আমরা তদন্ত করে ওই দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছিলাম। এখন মামলাটি বিচারাধীন। তবে তারা দু'জন জামিনে বাইরে রয়েছে। ওই ঘটনার পর এলএসডি বিক্রির চক্রগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

বিক্রিতে সক্রিয় অন্তত ১৫টি গ্রুপ

এলএসডি ব্যবসায় অন্তত ১৫ দল গ্রুপ রাজধানীতে সক্রিয় বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আব্দুল আহাদ। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মৃত্যুর পর ডিবির পাশাপাশি আমরাও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করি। এরপরই আমরা একটি চক্রকে সনাক্ত করি। শনিবার রাতে শাহজাহানপুর, রামপুরা, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করি। তারা হলেন, সাইফুল ইসলাম সাইফ (২০),  এসএম মনওয়ার আকিব (২০), নাজমুস সাকিব (২০), নাজমুল ইসলাম (২৪) ও বিএম সিরাজুস সালেকীন (২৪)। এরা রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রগুলোর সঙ্গে জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের কাজ চলছে। পাশাপাশি যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে, চক্রগুলোর ব্যাপারে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাবে।

গ্রেফতার পাঁচজনের কাছ থেকে দুই হাজার মাইক্রোগ্রাম এলএসডি, আরেক মাদক আইসের সঙ্গে গাঁজাও পাওয়া গেছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছর ধরে তারা এলএসডি সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তারা অনলাইনে তাদের এই ব্যবসার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। শিক্ষার্থীরা কীভাবে জড়িয়ে পড়ল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনলাইন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আকৃষ্ট হয়ে তারা এলএসডি সেবন শুরু করে। এরা মূলত কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এলএসডি সংগ্রহ করত।

২০১৫ সালের পরই বিশ্বে আলোচনায় আসে এলএসডি

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত বিশ্বে এলএসডি আটকের তেমন একটা তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালে আর্জেন্টিনায় এলএসডি এর একটা চালান আটক হয় যা ভারত থেকে আসে বলে জানা যায় । একই বছর নেদারল্যান্ডস থেকে যাওয়া আরেকটি চালান নিউজিল্যান্ডে আটক হয়। ২০১৮ সাল থেকে এলএসডির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। যদিও ২০১৭ সালে চিলিতে (কানাডা থেকে যাওয়া) ও উরুগুয়েতে ৬ পেজ ব্লটিং পেপার আটক হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত ২০৩টিরও বেশি এলএসডি চালান আটকের তথ্য পাওয়া গেছে। এ মাদক সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে। এরমধ্যে নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডে বেশি আটক হয়েছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো, বেলজিয়াম, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, স্পেন, কানাডা, জাপান, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইতালি, চিলি, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, কলম্বিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, নরওয়ে ও রাশিয়া। এখন পর্যন্ত ৩২টি দেশে এই মাদক ধরা পড়েছে।

এলএসডি মাদকটা আসলে কী?

এলএসডি হল এক ধরনের সিনথেটিক ড্রাগ, অর্থাৎ মানুষের তৈরি রাসায়নিক দিয়ে এটা তৈরি করা হয়। শস্যদানার ওপর জন্মানো বিশেষ ধরনের ছত্রাক থেকে উৎপাদিত লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে রাসায়নিক সংশ্লেষের মাধ্যমে ডি-লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি তৈরি করা হয়। সাধারণভাবে এলএসডি হয় বর্ণ ও গন্ধহীন। ব্লটার কাগজ, চিনির কিউব বা জেলটিনের আকারে এ মাদক বিক্রি করা হয়। মেহেদী হাসান বলেন, এই মাদক সেবনের পর রক্তচাপ বেড়ে যায়, দেহের তাপমাত্রাও বাড়ে, দৃষ্টি বিভ্রম বা হেলুসিনেশন হতে পারে। তখন নিজের ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য