তরুণ সমাজের জন্য বাজেট
৪ জুন ২০১৮সাম্প্রতিককালে দেশের সবচেয়ে বড় ঘটনার একটি কোটা সংস্কার আন্দোলন৷ আমরা দেখেছি, দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমেছেন তরুণরা৷ কোথাও কোথাও কম-বেশি সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে৷
এই ঘটনা বেশ ভালোই নাড়া দিয়েছে দেশ বিদেশে৷ অনেকেই ঘটনাগুলোকে অনেক রকমভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে অনেকের মত৷ কারো মতের সঙ্গে বিরোধে না গিয়ে আমি ভিন্ন এক ব্যাখ্যায় যেতে চাই৷ আমার মতে, তরুণদের এই রাস্তায় নেমে আসা, প্রতিবাদ জানানো, সিস্টেমের প্রতি অসন্তোষ সবকিছুর পেছনেই এক রকমের ‘হতাশা' কাজ করেছে৷
দেশের চাকরির বাজারে প্রতি বছর ২৫ থেকে ২৬ লাখ তরুণ যুক্ত হচ্ছেন৷ কিন্তু তাঁদের জন্য কতটা প্রস্তুত দেশের কর্মখাত? এখনো বহুদূর যেতে হবে৷ কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তার মাত্রা কম থাকলে এই কোটা সংস্কারের জন্য এতটা হয়তো উতলা হতেন না দেশের তরুণরা, বলে আমি মনে করি৷
চার বছর পুরোনো হলেও একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক একটি পরিসংখ্যানে৷ ২০১৪ সালে কমনওয়েলথ প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তরুণ বা যুবকদের কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে৷ বিশ্বের ১৮৩টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম৷ গত চার বছরে এই পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, তা মনে করার কারণ নেই৷
একটি বিষয় বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ৷ দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার গড় বয়স ২৪-এর নীচে৷ কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ৷ এটি একটি দেশের জন্য আশীর্বাদ, যদি তার জন্য প্রস্তুতি থাকে৷ ডেমোগ্রাফিক অ্যানালাইসিস করে বহু আগেই রাষ্ট্রের এ সময়ের জন্য প্রস্তুতি নেবার দরকার ছিল, যা হয়নি৷
বর্তমান সরকার প্রযুক্তি খাতকে বড় করার চেষ্টা করছে, যেখানে তরুণরাই মূল জনশক্তি৷ আইটি খাতে অনেক তরুণ উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন, যেটি ইতিবাচক৷ কিন্তু সরকারকে ভাবতে হবে, তরুণ দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রমোট করার জন্য আর কী কী করা যায়৷ সেটাই হওয়া উচিত তাঁদের অগ্রাধিকার৷ বিভিন্ন ফোরামে এ সব নিয়ে আলোচনা হয়৷ তাই শুধু এই খাতটি ধরে আমি বিস্তারিত যাচ্ছি না৷
অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিয়ে মানব সম্পদের উন্নয়ন করতে হবে৷ প্রয়োজন হলে, সম্পদ উন্নয়নে নেয়া উদ্যোগে সরকারের ভর্তুকি দিতে হবে৷ অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন জেনে ভালো লেগেছে৷ কিন্তু সেই গুরুত্ব শুধু একটি বাজেটে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না৷ নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা৷ বলতে হবে যে, আগামী ২০ বছরে বা ২৫ বছরে এ দেশে কোন পর্যায়ের মানবসম্পদের দক্ষতা কোন পর্যায়ে নেয়া হবে, সে কথা৷ প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দও সেভাবে করতে হবে৷ বিকশিত, বিকাশমান ও বিকাশ সম্ভব শিল্পের ভবিষ্যত বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী শিক্ষার নকশা তৈরি করতে হবে, এবং সেভাবে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে৷
যেমন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাত পোশাক৷ কিন্তু এই শিল্পকে মাথায় রেখে যে পরিমাণ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে তা কি পরিকল্পিত?
শুধু তাই নয়, শিল্পের উচ্চতর বিকাশে যে ধরনের শিক্ষা দরকার, তা নেই৷ যেমন, বাংলাদেশে অনেক আইটি বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু এখনকার বাজারে ডেটা সাইন্টিস্ট বা অ্যানালিস্টদের প্রচুর চাহিদা ও প্রয়োজন৷ তাই বাংলাদেশের আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের শিক্ষা চালু করতে হবে৷
আইটি উদ্যোক্তাদের কথা বলেছি৷ শুধু আইটি নয়, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নানা ধরনের ব্যবসায় আগ্রহীদের সংখ্যা অনেক৷ এ সব তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা দিতে হবে বাজেটে৷ এরই মধ্যে আগামী বাজেটে কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী৷ নিঃসন্দেহে দরকারি পদক্ষেপ৷
কিন্তু আরো যা করতে হবে, তা হলো এই তরুণদের জন্য ব্যবসার পথ আরো সহজ করা৷ ব্যবসার শুরুতে যে খরচ প্রয়োজন তার চাপ রাষ্ট্রকে আরো নিতে হবে৷ অনেকের ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি যে, এত আইনের মারপ্যাঁচে ব্যবসা শুরুর আকাঙ্খা থাকলেও পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন৷ ধাপে ধাপে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা৷ এ সব জায়গাগুলো যে জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ হতে হবে, তাতে কোনো দ্বিমত নেই৷ কিন্তু আরো সহজ করা যায় কীভাবে তা ভাবতে হবে৷
নীতিমালাও প্রণয়ন করতে হবে এমনভাবে যে, তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রকল্পে বিনিয়োগ করবার জন্য ব্যাংকগুলোতে যেন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়৷ বড় বড় রাঘব বোয়াল বা ঋণখেলাপীদের হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে দেউলিয়া হবার চেয়ে তরুণদের প্রকল্পে অল্প অল্প করে বিনিয়োগ করতে পারে ব্যাংকগুলো৷
সরকারের যে পরিকল্পনা তাতে বছরে আড়াই হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়৷ তরুণ ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রমোট করলে তারা এই অর্থ আনতে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস৷
পরিশেষে বলতে চাই, তরুণদের সুরক্ষা দিন৷ তাদের দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও একটা প্লাটফর্ম দেয়াই শুধু নয়, তাঁদের শ্রমেরও সুরক্ষা দিতে হবে৷ যে কেউ যে কোনো বেতনে যে কোনো সেক্টরে তাঁদের নিয়োগ দিলো, এরপর যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে পত্রপাঠ বিদায় করে দিলো, সেসব জায়গায় এখন না হলেও ভবিষ্যতে সুরক্ষা বর্ম তৈরি করতে হবে৷ তাতে তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা যেমন কমবে, তেমনি নিরাপদ সরকারি চাকরিতে যুক্ত হবার সম্ভাবনা বাড়াতে রাস্তায় নামবে না৷ একমাত্র সমতা ও নিরাপত্তাই সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে৷ তাই তা শুরু হোক বাজেট দিয়েই৷
পাঠক কেমন লাগলো ব্লগটি লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷