বিশাল বাজেট: কার কী যায় আসে
৫ জুন ২০১৮স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট দেওয়া হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৩০ জুন৷ প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে এক সঙ্গে ১৯৭১-৭২ এবং ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন৷ সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যখন ঢাকা মুক্ত হলো, তখন আমরা পেলাম এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেউলিয়া অর্থ ব্যবস্থা৷ রেলপথ, সড়ক ও নদীপথসমূহ তখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন; নিমজ্জিত জাহাজ আর ভাসমান মাইন দিয়ে বন্দরসমূহ বন্ধ; শিল্পসমূহ শত্রুর আঘাতে বিধ্বস্ত বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত; যন্ত্রপাতি আর কাঁচামালের অভাবে কল-কারখানা স্তব্ধ৷ স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই যে বহুবিধ সমস্যা নতুন সরকারের আশু মনোযোগ দাবি করছিল তার মধ্যে ছিল দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব, খাদ্যসামগ্রীর সীমিত সরবরাহ, শ্রম শক্তির বেকারত্ব৷ আর ছিল লক্ষ লক্ষ সহায়-সম্বলহীন মানুষ আর দেশে প্রত্যাবর্তনকারী অগণিত উদ্বাস্তুর মিছিল৷ এইসব সমস্যার সমাধান যে কোনো সরকারের জন্য ছিল দুঃসাধ্য আর সম্পদ ও বৈদেশিক মুদ্রাবিহীন এবং যথাযথ প্রশাসনযন্ত্রবর্জিত নতুন সরকারের জন্য এ ছিল এক অসম্ভব কাজ৷''
প্রথম অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যে চিত্র উপস্থাপন করেছিলেন, সম্ভবত পরিস্থিতি ছিল আরও খারাপ৷ যেমন, স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম রিপোর্ট করেছিল ১৯৭২ সালেরই ২৫ সেপ্টেম্বর৷ সেখানে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ‘‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল৷ এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি, জনসংখ্যার প্রবল আধিক্য এখানে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৪শ' মানুষ বাস করে, তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল অনেক কম, এখনো তা ৫০ বছরের নীচে, বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে এবং জনসংখ্যার বড় অংশই অশিক্ষিত৷''
সেই বাংলাদেশ এখন আর নেই৷ আর সেই বাজেটও নেই৷ যে বাজেট ছিল ২৮৫ কোটি টাকা আয় আর ২১৮ কোটি টাকা ব্যয়ের, সেটি এবার চার লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশ, কেবলই উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে৷ ৮০'র দশকেও উন্নয়ন বাজেট তো ছিলই, রাজস্ব বাজেটেও বৈদেশিক সাহায্য ঢুকে পড়েছিল৷ এক সময়ের সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর৷
এ তো গেল বাংলাদেশের একটা দিক৷ অর্থনীতির ভিন্ন চিত্রও আছে৷ দুর্নীতি বড় আকারেই রয়ে গেছে৷ অর্থের অপচয় হয় বড় মাত্রায়৷ জবাবদিহির জায়গা কমে গেছে৷ অর্থ খরচে স্বচ্ছতা কম৷ বিচারহীনতা আর্থিক কেলেঙ্কারি বাড়াচ্ছে৷ আর এসবের প্রভাবে সমাজে আয়বৈষম্য প্রবল হয়েছে৷
এরকম এক প্রেক্ষাপটে আরেকটি বাজেট আসছে৷ আগামী সাত জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নতুন বাজেট উপস্থাপন করবেন৷ তবে এই বাজেট নিয়ে আলোচনার আগে খানিকটা দ্বিধা কাজ করছে৷ কারণ, অর্থমন্ত্রীর আগামী বাজেট কতটা অর্থনীতি মেনে হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন৷ যদি আগামী ডিসেম্বরে নতুন নির্বাচন হয়, তাহলে তো নতুন বাজেটে অর্থনীতি কমই গুরুত্ব পাওয়ার কথা৷ এবারের বাজেট হবে মূলত নির্বাচনী বাজেট৷ এতে উন্নয়নভাবনা থাকবে কম, জনতুষ্টিই প্রাধান্য পাবে বেশি৷ কেননা, রাজনীতি মাথায় রেখেই মূলত সম্পদের বণ্টন হবে আগামী বাজেটে৷
বাজেট মানেই তো সম্পদ বণ্টন ও এর সঠিক ব্যবহারের চেষ্টা৷ যাদের সম্পদ কম, তাদের জন্য কাজটা আরও কঠিন৷ কেননা, যেসব দেশে আয়ের বৈষম্য বেশি, ধনীরা কেবলই ধনী হতে থাকে, তাদের জন্য ভরসা আসলে সরকারের বাজেটনীতি৷
এমনিতে বাংলাদেশের বাজেট তৈরি ও এর উপস্থাপনা নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই৷ বাজেট যত বড় হচ্ছে, বাজেট বক্তৃতাও তত বড় হচ্ছে৷ অর্থমন্ত্রী অনেক কথা বলে যান, আর তাতে অনেক সময়ই আসল কথাটিই হারিয়ে যায়৷ সাধারণ মানুষ যা জানতে চায় তা আর বাজেট বক্তৃতায় থাকে না৷ বাজেট বক্তৃতার ধরনটি আমাদের সেকেলে৷ কেবল বক্তৃতা আর বক্তৃতা৷ ফলে একেবারেই সাধারণ মানুষের কাছে বাজেটটি হয়ে থাকে দুর্বোধ্য৷ অথচ বাজেট তো দেশের সাধারণ মানুষের জন্যই৷
অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের সম্ভবত বিশাল অঙ্কের টাকার পরিসংখ্যানের প্রতি এক ধরনের মোহ আছে৷ আর তা বলতেও পছন্দ করেন৷ ফলে বাজেট নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হতে না হতেই তিনি সম্ভাব্য বাজেট পরিসংখ্যান দিতে থাকেন৷ সাংবাদিকরা বাজেট নিয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার আগেই অর্থমন্ত্রী আয়োজন করেই জানিয়ে দেন কত টাকার বাজেট হচ্ছে৷ সম্ভবত বিশাল অঙ্কের একটা বাজেট দেওয়ার আত্মপ্রসাদ থেকে তিনি এর আকারের কথা বলে দেন৷
আগামী বাজেট যে চার লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো হবে, সে তথ্য অর্থমন্ত্রীরই দেওয়া৷ অথচ এক সময়ে বাজেট গোপনীয়তা ছিল রহস্য উপন্যাস পর্যায়ের৷ বাজেটের তথ্য থাকতো অত্যন্ত গোপনীয়, কোনো সাংবাদিক উদ্ধার করতে পারলে সেটা হতো বড় ঘটনা৷ বাজেট উদ্ধারের রোমাঞ্চ থেকে সাংবাদিকদের বঞ্চিত করেছেন অর্থমন্ত্রী৷ এখানে বলে রাখি, বাজেট ফাঁস হয়েছিল বলে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী এডওয়ার্ড জন ডালটন (১৯৪৫-১৯৪৭) দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন৷ এসব তথ্য এখন কেবলই ইতিহাস৷
তবে একটা বাজেট কত কোটি টাকার, তাতে সাধারণ মানুষের কিছুই যায়-আসে না৷ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বাজেটের আকার নিয়ে এত আলোচনার নজিরও সম্ভবত পাওয়া যাবে না৷ কারণ, কত টাকার বাজেট নয়, বরং কার জন্য বাজেটে কী আছে, সেটাই আসল বিষয়৷ চলতি অর্থবছর হচ্ছে ২০১৭-১৮৷ এই অর্থবছরের বাজেট হচ্ছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার৷ এর মধ্যে ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটিই ছিল অনুন্নয়ন বা রাজস্ব ব্যয়৷ এটা হচ্ছে সরকারের চলতি ব্যয়৷ দৈনন্দিন কাজ চালাতে এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়৷
এখন দেখা যাক সরকারের চলতি খরচ কোথায় কোথায় হচ্ছে আর এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সরাসরি সম্পর্ক কতটা৷ এই অর্থের ২২ শতাংশ খরচ হয় বেতন-ভাতা দিতে৷ পেনশন খাতে ব্যয় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ৷ সুদ পরিশোধে ব্যয় ১৭ শতাংশ, সাহায্য ও মঞ্জুরি খাতে ব্যয় হয় আরও ১৭ শতাংশ অর্থ৷ পণ্য ও সেবা খাতে ১০ শতাংশ, ৮ শতাংশ খরচ হয় ভর্তুকি দিতে৷ অনুন্নয়ন বাজেটের বাকি অর্থ ব্যয় হয় নানাবিধ অপ্রত্যাশিত ব্যয় ও থোক বরাদ্দ খাতে৷ নতুন যে বাজেট আসছে তাতেও প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে এসব খাতেই৷ এই যদি হয় অর্থ ব্যয়ের খাত, তাহলে এ থেকে সাধারণ মানুষের লাভ কতটা?
এবার আসা যাক উন্নয়ন বাজেটের বিষয়ে৷ চলতি বাজেটের উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকার৷ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম উন্নয়ন বাজেট ছিল ৫ শ কোটি টকার৷ সেখান থেকে এই অগ্রগতি বিস্ময়কর৷ এক দশক আগেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উন্নয়ন বাজেট, যা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি নামে পরিচিত, ছিল অনেক কম৷ বর্তমান অর্থমন্ত্রীর কৃতিত্ব হলো তিনি এই হার বেশ খানিকটা বাড়াতে পেরেছেন৷ তবে এর পেছনে একটা গল্প আছে৷ সেই গল্প আসলে বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়াতে পারার ব্যর্থতার গল্প৷ জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের হার অনেক বছর ধরে এক জায়গাতেই আটকে ছিল৷ বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে না পেরে এর পরিপূরক হিসেবে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হয়েছে৷ এতে এডিপি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ আর এটা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বিপদটা ডেকে এনেছেন অন্যখানে৷
সীমিত সম্পদের দেশে আয়ের চেয়ে ব্যয় সব সময়েই বেশি৷ ফলে বাংলাদেশকে ঘাটতি বাজেটই করতে হয়, যদিও সীমিত আকারে ঘাটতি বাজেট করা অর্থনীতির জন্য ভালো বলেই মনে করা হয়৷ বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রীকে বেশি হারে ঋণ করতে হচ্ছে৷ এই ঋণ মূলত নেওয়া হয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে, কেননা, বিদেশি ঋণের উৎস কমে গেছে৷ অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফা বা সুদের হার বেশি৷ বেশি সুদের ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটান অর্থমন্ত্রী, এ জন্য সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে৷ আবার এ জন্য বাড়াতে হচ্ছে মোট বাজেটের আকার৷ সুতরাং বলা যায়, বাজেট ঘাটতি, ঘাটতি মেটাতে উচ্চ সুদের ঋণ গ্রহণ, ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত ব্যয়, তাতে আবার বাজেট বৃদ্ধি– এই চক্রে আটকা পড়েছে বাজেট৷ বিশাল বাজেটের পেছনে এ-ও এক রহস্য৷
বিশাল আকারের এই বাজেটের আরেকটা দিক আছে৷ বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থ মন্ত্রী যতই ঋণ করুন না কেন, তা কোনোভাবেই জিডিপির ৫ শতাংশকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না৷ তাতে বাজেট শৃঙ্খলা থাকবে না৷ তাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও আপত্তি৷ সুতরাং বড় বাজেটের জন্য রাজস্ব আদায়ের কোনো বিকল্প নেই৷ এটা সত্যি যে, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম৷ অবশ্যই তা বাড়াতে হবে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কর বাড়ানোর প্রশ্ন এলে যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের ওপরেই চাপ বাড়ে৷ যারা কর দেয় না, ফাঁকি দেয়, তারা আড়ালেই থেকে যায়৷ ফলে শেষ পর্যন্ত বিশাল বাজেটের কারণে রাজস্ব আদায়ের বাড়তি চাপটা মূলত পরে সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের ওপরই৷
অর্থমন্ত্রী নিজেকে উচ্চাভিলাষী বলতে পছন্দ করেন৷ উচ্চাভিলাষ থাকাটা দোষের কিছু না৷ বড় আয় আর বেশি ব্যয়ের বাজেটের প্রয়োজনও আছে৷ তবে বিশাল বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য কী থাকছে সেটাই জরুরি৷
কেমন লাগলো প্রতিবেদনটি লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷