তরুণদের তালেবানে যোগ দেয়া ঠেকাতে যা করছে পুলিশ
১৫ আগস্ট ২০২১গত ১০ মে চার তরুণকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট৷ তাদের মধ্যে একজন একটি বেসরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের, দুইজন দুইটি ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ও অন্যজন একটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী৷ সবার বয়স ২০ থেকে ২৯ বছর৷ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে গ্রেফতারের পর জানা যায় তারা আফগানিস্তানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন৷ তাদের কাছ থেকে পুলিশ তাদের দুই সঙ্গীর আফগানিস্তানে পৌঁছানোর খবর জানতে পেরেছে৷
পুলিশ জানায়, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কেউ কেউ আফগানিস্তানে পৌঁছার চেষ্টা করছে৷ দেশের ভিতরে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন চ্যাট গ্রুপের মাধ্যমেও তারা নিজেদের সংগঠিত করছে৷ তাদের ঠেকাতে সামজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন চ্যানেলসহ সাইবার ওয়ার্ল্ডে নজরদারি করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ তাছাড়া দেশের বাইরে যারা চলে গেছে তাদের দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখার কথা জানিয়েছে পুলিশ৷
কারা যাচ্ছেন
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গ্রেফতারকৃত চারজনের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্যই পেয়েছি৷ সেগুলো এখন যাচাই বাছাই করা হচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত কতজন সেখানে গেছে সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি৷ তবে গ্রেফতারকৃত এই চারজনের কাছ থেকে ‘সাইন্স প্রোজেক্ট' নামে একটি চ্যাট গ্রুপের তথ্য পেয়েছি৷ ওই গ্রুপে ১০ যুবক সম্পৃক্ত ছিল৷ তাদের চারজনকে আমরা গ্রেফতার করেছি৷ এই ১০ জন গত দুই বছর ধরে একে অপরকে চেনে৷’’
কাউন্টার টেররিজমের অপর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ১০ জনের মধ্যে দুইজন ইতিমধ্যে আফগানিস্তান পৌঁছেছেন বলে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে৷ তাছাড়া নোয়াখালির আরো একজন আফগানিস্তানে যাওয়ার পথে রয়েছেন৷
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তা যে দুইজন আফগানিস্তান গিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন তাদের একজনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে গত ২৫ মার্চ তার ভাই সিলেটের কোতয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন৷
রোববার যোগাযোগ করা হলে তার ভাই ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ভাই সিলেটের একটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ত৷ করোনা শুরুর পর সে বাড়ি চলে গিয়েছিল৷ তিন মাস কুমিল্লায় নিজেদের বাড়িতে থাকার পর এ বছরের শুরুর দিকে সে আমাকে জানায় কলেজে আসবে৷ আমি তার কাছে জানতে চাই, কোথায় থাকবে তুমি৷ সে বলে বন্ধুর কাছে থাকব৷ পরে আমি তাকে আসতে বলি৷ এখানে আসার দুই দিন পরই তাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না৷ মোবাইল ফোনও বন্ধ৷ পরে আমি জিডি করি৷ তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, আমার ভাই নাকি আফগানিস্তান গেছে৷ আমি বাবা-মাকে এখনও কিছু বলিনি৷ বয়স্ক মানুষ, তারা শুনলে কষ্ট পাবেন৷ আমাদের চার বোন আর তিন ভাই৷ বড় ভাই সৌদি আরবে থাকেন৷ ...পুলিশ বললেও আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না যে সে আফগানিস্তান গেছে৷ পরে জানলাম, তার সঙ্গে তার এক বন্ধুও নিখোঁজ রয়েছে৷’’
ভারতে গ্রেফতার
পুলিশের ভাষ্য সিলেটের ঐ শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিব্বির আহমেদ নামে আরো একজন নিখোঁজ হয়েছেন৷ শিব্বির স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়তেন৷ এছাড়া চ্যাট গ্রুপের ১০ জনের মধ্যে চারজন বাংলাদেশে গ্রেফতার হয়েছেন৷
ভারতের স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত জুলাইতে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) বেহালা থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করে৷ তারা নব্য জেএমবির সদস্য বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করা হয়৷ ঢাকার কাউন্টার টেরটিরজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, এই তিনজনও ওই ১০ জনের চ্যাট গ্রুপের সদস্য, যারা আফগানিস্তান যাচ্ছিলেন বলেই তাদের ধারণা৷
ভারতে যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে কীভাবে তথ্য জেনেছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো সবকিছু প্রকাশ করতে পারি না৷ গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে তথ্য আমরা ভারত সরকারের কাছ থেকে পাইনি৷ এটা গণমাধ্যম থেকেই পেয়েছি৷ তবে এরা যে বাংলাদেশ থেকে (আফগানিস্তান) যাওয়ার চেষ্টা করছিল, সেটা আমরা আগে থেকেই জানতাম৷’’
যেভাবে যাচ্ছেন
জানা যাচ্ছে ভারত হয়ে পাকিস্তান, এরপর আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করেন দেশটিতে পাড়ি জমাতে ইচ্ছুকরা৷ কোন সীমান্ত দিয়ে তারা পাকিস্তান যাচ্ছেন জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘এখানে বাংলাদেশের সব সীমান্তই ব্যবহার হচ্ছে৷ ধরেন কারও যোগাযোগ হল ত্রিপুরার কারও সঙ্গে৷ তখন সে ত্রিপুরা যাচ্ছে৷ আবার কারও যোগাযোগ হল পশ্চিমবঙ্গে কারও সঙ্গে, তখন সে পশ্চিমবঙ্গে যাচ্ছে৷ সেখান থেকে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান যাচ্ছে৷’’
আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের রুখতে কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘আমরা সামাজিকমাধ্যম থেকে শুরু করে সাইবার ওয়ার্ল্ডে নজরদারি চালাই৷ যদি আমরা টের পাই যে, কেউ ঐদিকে বা জঙ্গি হওয়ার দিকে যাচ্ছে তাহলে আমরা তার পরিবারকে সতর্ক করি৷ সে কী কী করছে তার পরিবারকে তা জানানো হয়৷ ঐ লাইন থেকে তাদের ফেরত আনার চেষ্টা করা হয়৷ যারা মোটামুটি অ্যাডভান্স পর্যায়ে চলে গেছে তাদের গ্রেফতার করি৷ এরা এতই মোটিভেটেড থাকে যে, আপনি কোনভাবে তাকে এই রাস্তা থেকে ফেরাতে পারবেন না গ্রেপ্তার করা ছাড়া৷ না হলে আজ হোক কাল হোক সে চলেই যাবে৷ এছাড়া আমাদের দৃষ্টি বাইরেও এমন থাকে যারা চলে যায়৷’’
এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে যাওয়া কতজনের বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন তা বলতে চাননি এই পুলিশ কর্মকর্তা৷ সাইবার ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে তাদেরকে আফগানিস্তানে যুদ্ধে অংশ নেয়া এবং পরবর্তীতে সেখানে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়ার প্রলোভন দেয়া হয় বলেও জানিয়েছেন শফিকুল ইসলাম৷
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের একজন শিক্ষার্থী গ্রেফতারের পর জানিয়েছেন, সিলেটে ‘আবদুল্লাহ’ নামে এক ব্যক্তি তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিল এবং তাদের পাসপোর্ট প্রস্তুত রাখতে বলেছিল৷ তার বন্ধু আফগানিস্তানে পৌঁছে তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল৷
বাংলাদেশের জন্য কতটা উদ্বেগের
আশির দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে তালেবানদের লড়াইয়ে যোগ দিতেও বাংলাদেশের কিছু মানুষ আফগানিস্তান গিয়েছেন বলে জানা যায়৷ সেসময় তালেবানদের সমর্থনে বাংলাদেশে মিছিল সমাবেশও করে কিছু গোষ্ঠী৷ শনিবার ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, তালেবানদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের কিছু মানুষ ঘর ছাড়ছেন৷
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তালেবানরা বাংলাদেশি জঙ্গিদের লাইটহাউজ (বাতিঘর)৷ তারা জেগে উঠলে বাংলাদেশি জঙ্গিরাও জেগে উঠে৷ আমরা জেনেছি, বাংলাদেশের তরুণদের হিজরতে যোগ দিতে তারা আহ্বান জানিয়েছে৷ এই আহ্বান না জানালেও তারা সেখানে যেত৷ কী সংখ্যক সেখানে এখন পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ সড়কপথে তাদের যেতে হলে ভারতের পাঞ্জাব, কাশ্মীর বা রাজস্থান দিয়েই যেতে হয়৷’’
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিদের নিয়ে প্রতিবেদন করছেন বর্তমানে একুশে টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক দীপু সারওয়ার৷ তিনি মনে করেন আগ্রহ থাকলেও এখন বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে পৌঁছানো আগের মতো সহজ নয়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি আফগানিস্তানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেই সেখানে এখন যাওয়া সম্ভব না৷ তারপরও বলবো কট্টরপন্থীরা মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সীমানা ব্যবহার করেও আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু এটি খুব সহজ কাজ বলেও মনে করি না৷ বেশির ভাগ দেশই কট্টরপন্থীদের উপর নজরদারি বাড়িয়েছে৷ সম্প্রতি তালেবানদের কর্মকাণ্ড কট্টরপন্থীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করলেও তা ভয়াবহ রুপ নেবে বলে মনে করি না৷’’