‘তারা টিভি’ বাঁচানোর লড়াই
৩০ এপ্রিল ২০১৩১৪২০ সালের পয়লা বৈশাখের সকালে কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রায় সবাই বোধহয় আটকে ছিলেন তারা মিউজিক টিভি চ্যানেলটির বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে৷ যদিও শুভ নববর্ষ নয়, তারা-র তিনটি টিভি চ্যানেলের কয়েকশো কর্মী এবং তারার অগণিত দর্শকের জন্যও দারুণ অশুভ বার্তা বয়ে এনেছিল এবারের বাংলা নতুন বছর৷ কারণ, ঠিক তার আগের দিন মাঝরাতে সারদা সংস্থার কর্ণধার এবং তারা টিভি-র মালিক সুদীপ্ত সেন একটি ই-মেল মারফৎ জানিয়ে দিয়েছিলেন, পয়লা বৈশাখ থেকে তাঁর মালিকানাধীন সবকটি সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল তিনি বন্ধ করে দিচ্ছেন৷ চিট ফান্ডের মাধ্যমে বহু মানুষের টাকা আত্মসাৎ করে ফেরার সুদীপ্ত সেনের তরফ থেকে সেটাই ছিল তারা টিভি-সহ ১০টি সংবাদমাধ্যমের প্রায় ১২০০ সংবাদকর্মীর জন্য নববর্ষের উপহার৷
নতুন বছরের প্রথম দিনে এমন অপ্রত্যাশিতভাবে কর্মহীন হয়ে যাওয়ায় সকলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল৷ কিন্তু তারা টিভি-র সাংবাদিক কর্মীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েও তাঁদের মনোবল হারাননি৷ বরং ওঁরা ঠিক করেছিলেন, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানকেই তাঁরা কাজে লাগাবেন৷ নিজেদের বিপন্ন অবস্থার কথা রাজ্যবাসীকে জানিয়ে সহযোগিতা চাইবেন, যাতে তারা টিভি বন্ধ না হয়৷ এমন অভিনব প্রতিবাদে সাড়াও মিলল অভূতপূর্ব৷ এক তো কথা ছড়াল মুখে মুখে৷ রাজ্যজুড়ে মানুষ তারা টিভির সেই অনুষ্ঠান দেখলেন সারা সকাল ধরে এবং ফোন করে, ই-মেল করে জানালেন, তাঁরা তৈরি আছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে৷ আর তারা টিভি-র কর্মীদের এই সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় স্বেচ্ছায় শরিক হলেন শিল্পীরাও, যাঁরা অনেকেই তারা-র অনুষ্ঠানের নিয়মিত অতিথি ছিলেন৷ বহু নবীন শিল্পী, যাঁদের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ গড়ে দিয়েছিল তারা টিভি-র অনুষ্ঠান, তাঁরাও দাঁড়ালেন তারা-র পাশে, এই বিপন্ন সময়ে৷
‘‘প্রচুর ফোন, মেল আমরা পেয়েছি অ্যামেরিকা এবং ইংল্যান্ড থেকে, যাঁরা তারা-র অনুষ্ঠান নিয়মিত ইন্টারনেটে দেখেন, তাঁদের কাছ থেকে৷ প্রতিবেশী বাংলাদেশে এখন যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, কিন্তু ওখান থেকেও বহু মানুষ ফোন করেছেন৷ প্রত্যেকের বক্তব্য একটাই – বলুন, তারা টিভি-কে চালু রাখতে কত টাকা লাগবে৷ আমরা টাকা দেব৷'' জানালেন তারা টিভি-তে কর্মরত অনুষ্ঠান প্রযোজকদের একজন, অশোক জোয়াদ্দার৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এভাবে তো চাইলেই বাইরে থেকে টাকা সংগ্রহ করে চ্যানেল চালানো যায় না৷ বিশেষত সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সারদা সংস্থার মালিক সুদীপ্ত সেন যতক্ষণ না তারা-র তিনটি চ্যানেলের মালিকানা আইন মোতাবেক হস্তান্তর করছেন, ততক্ষণ দ্বিতীয় কোনও লগ্নিকারও এগিয়ে আসতে পারবেন না৷ তাই ভাবা হচ্ছে, যদি কর্মীদের কোনও সমবায় সংস্থা গড়ে বাইরের ওই আর্থিক সাহায্য নেওয়া সম্ভব হয়, জানালেন অশোক৷
তারা টিভি-র পয়লা বৈশাখের ওই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ার পরই বার্তা পাঠিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে, তারা-কে বন্ধ হতে দেওয়া হবে না৷ তারা-র কর্মীদের তিন মাস বেতন দেওয়া হয়নি শুনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এককালীন ১০ লক্ষ টাকার এক অর্থসাহায্য দেওয়ার নির্দেশ নিজের দপ্তরকে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ নতুনভাবে তারা-র যাত্রা শুরুর জন্য এখনও তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন তারা-র কর্মীরা৷ আর শিল্পীরাও যে যাঁর সাধ্যমত সাহায্য করছেন৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রানী সেন একবার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছেন, কারণ তিনি শুনেছিলেন তারা-র কর্মীরা, যাঁরা অফিসেই এখন ঘাঁটি গেড়েছেন যাতে চ্যানেলের সম্পত্তি বেহাত না হয়, তাঁরা নাকি কোনোমতে সেদ্ধভাত খেয়ে রাত কাটাচ্ছেন৷ ‘‘অন্তত একদিন যাতে ওঁরা ইচ্ছেমত খেতে পারেন, সেই জন্যেই টাকাটা দিয়েছিলাম৷ কিন্তু শুনলাম ওঁরা টাকাটা খরচ না করে জমিয়ে রেখে দিয়েছেন'', বললেন ইন্দ্রানী সেন৷
কিন্তু ইন্দ্রানী সেন, বা পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, শ্রীকান্ত আচার্য, শ্রাবণী সেন, হৈমন্তী শুক্লা বা কালিকাপ্রসাদের মতো শিল্পীরা, যাঁরা সেই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানেই তারা টিভি-র পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন, তাঁরা কি আরও কিছু করার কথা ভাবছেন? ইন্দ্রানী সেন জানালেন, একটা কথা তাঁরা ভেবেছেন যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে যদি কোনও সরকারি প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া যায়, সেখানে শিল্পীরা সবাই বিনা পারিশ্রমিকে একটা অনুষ্ঠান করে কিছু অর্থসংগ্রহ করে দিতে পারেন৷ যদিও সেই টাকা চ্যানেল চালানোর জন্য অবশ্যই যথেষ্ট হবে না৷ কিন্তু কর্মীদের অর্থকষ্ট কিছুটা হলেও ঘুচবে৷ আর ভরসা দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পাশাপাশি তারা টিভির অগণিত দর্শক আর শুভানুধ্যায়ীরা তো আছেনই, যাঁরা সুখে-দুঃখে তারা-র সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷