আত্রেয়ীর পানি নিয়ে নয়া বিতর্ক
১২ মে ২০১৭তিস্তা নদীর জল বা পানিবণ্টন নিয়ে এখন যুযুধান দুই বাংলা৷ এই পরিস্থিতিতে কিছুটা কোণঠাসা মমতার হাতে পাল্টা অস্ত্র আত্রেয়ী৷ রাজনৈতিক কারণেই জেলার মানুষ ডাক দিয়েছে, বাঁধ ভেঙে দাও বাংলাদেশ৷ তবে তোমাদের পানির দাবি মানা হবে৷
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাণরেখা আত্রেয়ী নদী৷ স্বাধীনতার সময় দুই বাংলার অনেক কিছুর মতোই আত্রেয়ীর হৃদয় দিয়ে কাঁচি চলেছে৷ তাতে স্থানীয় মানুষজনের আদরের আত্রাই বা আত্রেই এখন দু'দেশের মধ্যে একাধিক খণ্ডে বহমান৷ এই নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩৯০ কিলোমিটার৷ শিলিগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল থেকে আত্রেয়ী ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে৷ সেখানে দিনাজপুর জেলা ঘুরে ফের এপারে দক্ষিণ দিনাজপুরে তার প্রবেশ৷ বালুরঘাট ও কুমারগঞ্জ ব্লককে শস্যশ্যামলা করে আবার তা বাংলাদেশের হাতছানিতে সে দেশে ঢুকে পড়েছে৷
এতদিন কার্যত সংবাদের বাইরে থাকা আত্রেয়ী কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতিয়ার হয়ে উঠল? সেটা বুঝতে গেলে, একটু পিছনে তাকাতে হবে৷ ভারতের অংশে একসময়ের বেগবতী এই নদী এখন শীর্ণকায়৷ বছরের অধিকাংশ সময়ই তাতে পানি থাকে না৷ নদীর বুকে চরের পরিধি ক্রমশ বাড়ছে৷ এই নদীর জলেই পুষ্ট পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কৃষি৷ কুমারগঞ্জ, বালুরঘাট, চকভৃগুর কৃষিজীবীর কাছে আত্রেয়ীর জলই প্রধান রসদ৷ কিন্তু, নদীর আর সেই বেগ নেই, এপারের ক্ষীণস্রোতা আত্রেয়ী নিঃস্ব, সে আর কৃষক সমাজকে কী দেবে! বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের চাপের মুখে এই নিঃস্বতাকেই হাতিয়ার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী৷
এ মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তরবঙ্গে জনসভা করেন মমতা৷ সেখানেই তাঁর মুখে আত্রেয়ী নিয়ে জোরদার জেহাদের সুর শোনা যায়৷ জেহাদের নেপথ্যে এই নদীর উপর তৈরি করা বাংলাদেশের বাঁধ৷ তাঁর অভিযোগ, ঢাকা ওপারে আত্রেয়ীতে বাঁধ দিয়েছে৷ এর ফলে এদিকে জল প্রায় আসছেই না৷ তাই নদী একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে৷ কৃষকদের চাষবাসে সমস্যা হচ্ছে৷ আবার বর্ষার সময় লকগেট খুলে দেওয়া হচ্ছে৷ তাতে এপারে অনেক জায়গা ভেসে যাচ্ছে৷ এই অভিযোগ করেই মমতা তিস্তার পাল্টা অস্ত্র ব্যবহার করেন৷ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ যদি জল চায়, আমরা সাধ্য মতো দেওয়ার চেষ্টা করব৷ কিন্তু ওপারে আত্রেয়ীর উপর বাঁধ ভেঙে দিতে হবে৷ আমাদেরও জল দরকার৷'' বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার মধুর সম্পর্কে কিছুটা সমস্যা তৈরি করেছে তিস্তা বিতর্ক৷ এর পিছনে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল দিল্লির ইন্ধনও দেখছে৷ সে ব্যাপারে সচেতন মমতা বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আমাদের মিত্র৷ বন্ধু দেশকে বলব, বাঁধ সরিয়ে নিন৷ এপারের কৃষকরা বাঁচুক৷''
যে বাঁধ নিয়ে বিতর্ক, তা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে কাছেই৷ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কুমারগঞ্জের সমজিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকেছে আত্রেয়ী৷ সমজিয়া থেকে মাত্র ১৪০০ মিটার দূরে মোহনপুরে চিনের সহযোগিতায় নদীর উপর বাঁধ তৈরি করেছে বাংলাদেশ৷ এর ফলেই গত দু'বছর ধরে দক্ষিণ দিনাজপুরে জলসংকট দেখা দিয়েছে বলে এপারের মানুষের অভিযোগ৷ এই জেলার প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকায় বহমান আত্রেয়ী৷ সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এই এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় রয়েছে, যার জন্য আত্রেয়ীর জলের উপর নির্ভর করতে হয়৷ গ্রীষ্মকালে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ ব্যবস্থা কোনো কাজে আসছে না৷ জলের অভাবে কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে৷ এ বছর দফায় দফায় বৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা ভালো, গত বছরের তুলনায় বেশি জল রয়েছে আত্রেয়ীতে৷ তবে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না, ঘোর অনিশ্চয়তাও থাকবে৷ শুধু কৃষি নয়, মৎস্যজীবীরাও এই নদীর উপর নির্ভরশীল৷ পরিবহণের ক্ষেত্রেও আত্রেয়ী গুরুত্বপূর্ণ৷
আত্রেয়ী বাঁচানোর আন্দোলন মুখ্যমন্ত্রীর দাবিতে নতুন প্রাণ পেয়েছে৷ বাংলাদেশকে মোহনপুরের বাঁধ ভেঙে দিতে হবে, ক্রমশ এই দাবি জোরালো হচ্ছে৷ ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাক্ষর সংগ্রহ করছে, দাবিপত্র জমা দিচ্ছে প্রশাসনের কাছে৷ কিন্তু একটি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে এত সহজে সমাধান সম্ভব নয়, সেটা দু'পক্ষেরই জানা আছে৷ তাই তিস্তার পর আত্রেয়ী ভারতীয় রাজনীতির এক নয়া বিতর্কের রসদ হয়ে উঠেছে৷ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি ও পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে রাজনৈতিক লড়াই এখন তুঙ্গে৷ তাতে আরও ইন্ধন জোগাচ্ছে রুখা-শুখা এক নদী৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আত্রেয়ীর প্রসঙ্গ সামনে এনে ভারত সরকারের উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করেছেন৷ বাংলার রাজনীতিতে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকা বিজেপির মোকাবিলায় এটা তৃণমূলনেত্রীর আর একটি চাল বলে মনে করছেন রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা৷ বাংলাজুড়ে গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ঝড় উঠলেও দক্ষিণ দিনাজপুরে বামেরা ভালো ফল করেছিল৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্রমশ বামেদের ভোটব্যাংক দখল করছে৷ উত্তরবঙ্গে এই জেলাতে যদি রাজনৈতিক জমি বামেদের হাত থেকে গেরুয়া শিবিরের কাছে যায়, সেটা মমতার মাথাব্যথা বাড়াবে৷ তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী – কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্যের দাবির কথা বলে তিস্তার পাল্টা চাপ দিচ্ছেন এবং উত্তরবঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের প্রতিষেধক প্রয়োগ করছেন৷ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জিগির তুলে সহজেই বিজেপি দক্ষিণ দিনাজপুরের মানুষের মন জয় করতে পারত৷ কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর দল দেরি করায় আত্রেয়ীর অস্ত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী৷
আত্রেয়ী প্রসঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ আগামীতে আরও তীব্র হতে চলেছে, এমনই ইঙ্গিত মিলেছে বালুরঘাটের তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ ও নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষের কথায়৷ তাঁর ক্ষোভ, ‘‘গত বছর ১০ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছিলাম৷ কিছুদিন আগে তার জবাব পেয়েছি৷ তাতে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷'' অর্পিতার প্রশ্ন, ‘‘একটা আন্তর্জাতিক বিষয়ে রাজ্য সরকার কীভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলবে? মোদী সরকারের এই পরামর্শ হাস্যকর৷'' সাংসদ জানিয়েছেন, ‘‘আমি আবার আত্রেয়ীর প্রসঙ্গ লোকসভায় তুলব৷ কেন্দ্রের কাছে হাস্যকর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা চাইব৷'' বিশ্লেষকদের একাংশের মত, বিজেপির রাজনৈতিক ইস্যু মমতা কেড়ে নেওয়ায় পাল্টা তিস্তা নিয়ে চাপ বাড়াতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার৷ বাংলাদেশের সঙ্গে বোঝাপড়া যাই হোক, ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে উর্বর করে তুলেছে নদীর জল৷
এই দুই নদীর বহমানতার অতীতে তাকালে মনে হবে, তিস্তার গর্ভেই যেন আত্রেয়ী বিতর্কের বীজ লুকিয়ে ছিল৷ তিস্তার তিনটি শাখানদীর একটি থেকে আত্রেয়ীর জন্ম৷ পরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে গতিপথ বদলে যায়৷ তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আত্রেয়ী৷ বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের মধ্যে যেন অন্তঃসলিলা যোগ বিদ্যমান আজও৷ তাই কি তিস্তা বিতর্কের মধ্যেই চর সরিয়ে জেগে উঠেছে আত্রেয়ী? জলবণ্টন-বিতর্ক ভাবাচ্ছে বাংলার নাগরিক সমাজকেও৷ পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ অবশ্য মমতারই পাশে৷ তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর বিকল্প প্রস্তাবের উপর জোর দিচ্ছেন৷ কবি সুবোধ সরকারের মত, ‘‘নদীর জল উত্তরবঙ্গের জন্য আমাদেরও দরকার৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী তোর্সা বা অন্যান্য নদী নিয়ে যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন, তা ভেবে দেখা দরকার৷ দু'দেশের আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চয়ই পথ বেরিয়ে আসবে৷''