ক্রসফায়ার আতঙ্কে অনেক পরিবার
৩১ মার্চ ২০১৭বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি নুরুল আলম নুরুকে তাঁর চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরার বাসা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বুধবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে৷ এঘটনার ছয় ঘণ্টার মাথায় তাঁর লাশ পওয়া যায় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় কর্নফুলি নদীর তীরে৷ স্থানীয়রা লাশ পড়ে থাকতে দেখেন৷ পরিবারের সদস্যরা লাশের খবর পান সকাল ১১টার দিকে৷ এরপর বিকেল চারটার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে৷
তাঁকে যখন রাতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অন্যান্যের মধ্যে ভাগ্নে রাশেদুল ইসলাম বাসায় উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাত-আট জন সিভিল পোশাকে ছিল আর দু-তিনজন ছিল পুলিশের পোশাকে৷ তাদের হাতে ছিল শট গান এবং চাইনিজ বন্দুক৷ তারা দরজা নক করে ঘরের ভিতরে ঢুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার মামাকে তুলে নিয়ে যায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘এরপরই আমরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি, থানার ওসিকে জানাই৷ কিন্তু পুলিশ বিষয়টি অস্বীকার করে৷ তারা জানায়, পুলিশের কেউ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়নি৷ পরে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে তাঁর লাশ পরে থাকার খবর পাই আমরা৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘নুরুর মাথায় তিনটি গুলির চিহ্ন আছে আর কাধে আছে জখমের চিহ্ন আছে৷ তাঁর হাত-পা দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, মুখ ও চোখ বাধা ছিল ওড়না এবং জামা দিয়ে৷''
পরিবারের পক্ষ থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত মামলা করা হয়নি৷ পুলিশের দাবি, নুরুল আলম নুরু একাধিক মামলার আসামি৷ তবে ভাগ্নে রাশেদুল ইসলাম জানান, ‘‘যেহেতু তুলে নেওয়ার সময় পুলিশের পোশাক পরা লোকজন ছিল, তাই তদন্ত করে দেখা হবে ওরা আসলেই পুলিশের লোক কিনা৷ এমনটাই জানিয়েছে পুলিশের কর্মকর্তারা৷''
এদিকে ঢাকার বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো' শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানায়, গত ১০ দিনে বাংলাদেশের চারটি জেলা থেকে একজন কলেজ অধ্যক্ষসহ অন্তত ১২ জনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ এরমধ্যে ঝিনাইদহে পাঁচজন, চট্টগ্রামে এক পরিবহন ব্যবসায়ী ও তাঁর দুই শ্যালক, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে তিন যুবক এবং রাজশাহীর বাগমারা থেকে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়৷
এছাড়া কোটচাঁদপুর থেকে একটি কলেজের অধ্যক্ষকেও তুলে নেওয়া হয়৷ কোটচাঁদপুর পৌর কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ন কবিরকে বুধবার দুপুরে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তাঁর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছে৷
প্রথম আলোর খবরে আরো বলা হয়, ‘‘সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর স্বজনেরা বলছেন, তাঁরা কোথাও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পাচ্ছেন না৷ থানায় খোঁজ নিতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে যে, এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানে না৷'' পরিবারগুলোর সদস্যরা তাই এখন ক্রসফয়ার আতঙ্কে আছেন৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে অবশ্য এ সব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে৷
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র শুক্রবার তাদের এক প্রতিবেদনে বলে, গত তিন মাসে সারাদেশে ক্রসফায়ারে অন্তত ৫৯ জন নিহত হয়েছেন৷ এরমধ্যে ৩১ জনই পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন৷ বাকিরা র্যাব ও ডিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন৷
এ সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় ২৫ জনকে৷ এঁদের মধ্যে চারজন ফিরে এলেও, বাকিদের কোনো খবর পচ্ছেন না তাঁদের পরিবারের সদস্যরা৷
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এ সব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি৷ এপ্রিল মাসেই আমরা সেটা গঠন করতে চাই৷ আমরা জানতে চাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে যাঁদের তুলে নেয়া হচ্ছে, তাঁদের আসলে কারা তুলে নিচ্ছে?''
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উঠছে, তাই পুলিশকেই এটা তদন্ত করে দেখতে হবে৷ আর পুলিশ জড়িত না থাকলেও কারা জড়িত, সেটাও পুলিশকে বের করতে হবে৷ কারণ নাগরিকদের নিরপত্তা দেোয়া তাদেরই কাজ৷''
ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ক্রসফায়ার নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ তাই প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করা দরকার৷ তদন্তের মাধ্যমে সরকারকে জানাতে হবে ক্রসফায়ার যৌক্তিক ছিল কিনা৷ এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে৷ এছাড়া পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ধরে এনে ক্রসফয়ার করার৷ তাই পুলিশকেও প্রত্যেকটি ঘটনার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে৷''
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷