দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধরা মুসলমানদের ভয় পায় কেন?
২৮ মার্চ ২০১৮কয়েকদিন আগে শ্রীলংকার ক্যান্ডিতে চার মুসলমানের হামলায় এক বৌদ্ধ নাগরিকের আহত হওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মসজিদ, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছিল৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল সরকার৷ এছাড়া ১২ দিনের জন্য সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল৷ কারণ, ‘বুদ্ধিস্ট ফোর্স' নামে ভিক্ষুদের একটি সংগঠনসহ মৌলবাদী বৌদ্ধরা মুসলিমদের উপর হামলা চালাতে মানুষজনকে উৎসাহী করতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছিল৷ সেখানে তারা এমনও বলার চেষ্টা করেছিল যে, বৌদ্ধ জনসংখ্যা কমাতে মুসলমানরা নাকি খাবার আর কাপড়ে ‘কন্ট্রাসেপ্টিভ' মিশিয়ে দিচ্ছে!
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলমানরোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার পেছনেও মৌলবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি অংশের ভূমিকা রয়েছে৷
আর থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলমানপ্রধান রাজ্যগুলোতে ২০০১ সাল থেকে মাঝেমধ্যেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ ‘ব্যাংকক পোস্ট' দৈনিকের হিসেবে ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঐ অঞ্চলে সহিংসতায় কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে একটি স্বাধীন ইসলামি খেলাফত গড়ে তোলার লক্ষ্যে কয়েকটি ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে৷ সরকার তাদের কঠোরভাবে দমন করতে চায়৷ ফলে সহিংসতা তৈরি হয়৷ তবে মারা যাওয়া প্রতি দশজনের নয়জনই সাধারণ নাগরিক ছিলেন বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷
শ্রীলংকা, মিয়ানমারের মতো থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও সংঘাতের একটি অংশ৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে থাইল্যান্ডের একজন জনপ্রিয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ফেসবুকে বলেছিলেন, একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করলে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি মসজিদ পুড়িয়ে দেয়া উচিত৷ এই ঘোষণার পর ঐ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে সন্ন্যাসী সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল৷
ইসলামোফোবিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়ংসটাউন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মচর্চার অধ্যাপক মাইকেল জেরিসন ডয়চে ভেলেকে বলেন, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরা আশংকায় আছেন৷ ‘‘এই তিন দেশের ভিক্ষুরা মনে করেন, বৌদ্ধ ধর্ম হুমকির মুখে আছে৷ ইসলাম আর মুসলমানরা তাঁদের দেশ দখল করে নেবে বলে আশংকা তাঁদের,'' বলেন তিনি৷ জেরিসন মনে করেন, মুসলমানদের নিয়ে বৌদ্ধদের এই ভয়ের কারণ অনেক পুরনো৷ মিয়ানমার আর শ্রীলংকা যখন ব্রিটিশদের অধীনে চলে গিয়েছিল, তখন বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব নিয়ে শংকায় পড়েছিলেন ঐ দুই দেশের বৌদ্ধ অনুসারীরা৷ আর থাইল্যান্ড সেইসময় স্বাধীন থাকলেও প্রতিবেশী দেশগুলো ব্রিটিশ আর ফ্রান্সের অধীনে থাকায় সে দেশের বৌদ্ধরাও ধর্ম নিয়ে শংকায় ছিলেন৷ এই ভয়ের কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় শ্রীলংকা আর মিয়ানমারের নাগরিকদের মনে জাতীয়তাবাদ আর ধর্ম রক্ষার বিষয়টি এক হয়ে ধরা দিয়েছিল, বলে মনে করেন জেরিসন৷ এখনও সেই ধারা বিদ্যমান৷ ফলে সেসব দেশে আজও ধর্মীয় পরিচয় আর জাতীয় পরিচয়কে আলাদা করা অসম্ভব বলে জানান তিনি৷ ‘‘মিয়ানমারের একজন সত্যিকারের নাগরিক হওয়া মানে হচ্ছে একজন বৌদ্ধ হওয়া,'' মন্তব্য জেরিসনের৷
এছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মানুষের মনে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে ধারণা গড়ে উঠেছে সেটিও ঐ তিন দেশের বৌদ্ধদের মনকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করেন ধর্মচর্চার অধ্যাপক জেরিসন৷ ‘‘পশ্চিমের অনেক মানুষ বৌদ্ধ ধর্মকে শান্তিপূর্ণ মনে করে, আর ইসলামকে মনে করে সংঘাতের ধর্ম, যা আসলে সত্য নয়,'' বলেন তিনি৷
রডিয়ন এবিগহাউজেন/জেডএইচ