দখল হয়ে যাওয়া ঢাকার প্রাচীন স্থাপনা
১৯ নভেম্বর ২০১৭পুরনো ঢাকার ফরাশগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে অন্যতম একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা রূপলাল হাউস৷ ২০০৪ সালে প্রথম ছবি তুলতে যাই বাড়িটির৷ সামনে থেকে বাড়িটি খুঁজে বের করাই কঠিন৷ অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়ে ভেতরে ঢুকি৷ বাড়িটি দখল করে ভেতরে গেড়ে বসেছ বেশ কিছু মসলা আর সবজির আড়ৎ৷ ক্যামেরা দেখেই তখন তেড়ে এসেছিলেন এক ব্যবসায়ী৷ ধমকের সুরে তার প্রশ্ন ছিল ‘এ সবের ছবি তুলে হবেটা কী?' অনেকটা ভয় পেয়েই সেখান থেকে বেরিয়ে আসি৷ পরে বহু কষ্টে পাশের একটি ভবনের ছাদে উঠে সেবার ছবি তুলেছিলাম৷
রূপলাল হাউজ পুরনো ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা৷ ফরাশগঞ্জের রূপলাল দাস এবং রঘুনাথ দাস নামে ব্যবসায়ী দুই ভাই মিলে এটি নির্মাণ করেন৷ ১৮৪০ সালে তাঁরা আরাতুন নামে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি পুরানো ভবন কিনে নেন৷ পরে কলকাতার মার্টিন কোম্পানির একজন স্থপতিকে দিয়ে রূপলাল হাউস তৈরির কাজ শেষ করেন তাঁরা৷ সে সময়ে ভবনটিকে জৌলুসের দিক থেকে আহসান মঞ্জিলের সঙ্গে তুলনা করা হতো৷ জানা যায়, ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিনের ঢাকা সফরকালে তাঁর সম্মানে বল-নাচের আয়োজন করা হয়েছিল৷ আর সেজন্য রূপলাল হাউজের হলঘরটি দু'দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন ইংরেজরা৷ ঢাকায় শুধু আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউজেই বল নাচের উপযোগী হলঘর ছিল তখন৷
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় দাস পরিবারের সদস্যরা ভারতে পাড়ি জমান৷ এরপর থেকে মূল্যবান এ স্থাপনাটি দখল হতে থাকে৷ গত কয়েক বছর ধরে বাড়িটির কিছু অংশ সেনাবাহিনীর দখলে থাকলেও এখনো কিছু অংশ থেকে গেছে অবৈধ দখলে৷ এমনকি বাড়ির ভেতরে বাস করছে কিছু পরিবারও৷ গত বছরেও বাড়িটির ছবি তুলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হই৷ অগত্যা উপায় না পেয়ে নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বাড়িটার ছবি তুলি৷
এই হলো রূপলাল হাউসের বর্তমান অবস্থা৷ বিশাল এই ভবনটি এখন যেন ধ্বংসের প্রহর গুনছে৷ অথচ কোনো সরকারই অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে স্থাপনাটি উদ্ধার করে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷
পুরনো ঢাকার আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা বড় কাটরা৷ স্থাপনাটির নামেই এখন জায়গাটির নাম৷ ২০১৩ সালে ছবি তুলতে যাই সেখানে৷ চকবাজার থেকে অলিগলি পেড়িয়ে বড়কাটরার তোরণটি খুঁজে পাই৷ অনেক খুঁজে ভেতরে যাবার পথও পেয়ে যাই৷ তবে হাতে ক্যামেরা দেখে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন বড় কাটরার উপরের দিকটা দখল করে থাকা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ৷ তবে মাদ্রাসার এক শিক্ষককে হাত করে ভেতেরে প্রবেশের অনুমতি পাই৷
প্রাচীন আমলের চুন-সুরকির সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে গিয়ে থমকে যাই আমি৷ হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে দেয়ালের একটি অংশ ভাঙছিলেন একজন৷ তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি, দেওয়াল ভেঙে দরজা বানানো হচ্ছে৷ এমন একটা পুরাকীর্তি নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে অথচ সেটা দেখবার কেউ নেই! মনে মনে খুব কষ্ট পাই৷
ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই বড় কাটরা৷ ১৬৪৩-৪৪ খ্রিষ্টাব্দে চকবাজারের দক্ষিণ পাশে বুড়িগঙ্গার তীরে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে তৈরি হয়েছিল এটি৷ প্রথমে এতে শাহ সুজার বসবাসের কথা থাকলেও, পরে অবশ্য এটা ব্যবহৃত হয় মুসাফিরখানা হিসেবে৷ তারপর? যুগে যুগে শুধুই দখল হয়েছে স্থাপনাটি৷ নীচের দিকের বাইরের অংশটা বিভিন্ন দোকান আর ভেতরের অংশটা দখল করে বসবাস করছে কয়েকটি পরিবার৷ দখল হতে হতে বিশাল এ স্থাপনাটি আজ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর৷ এমনকি এর প্রধান তোরণটিও দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি৷
বড় কাটরার ছবি তোলা শেষ করে হাঁটতে থাকি ছোট কাটরার দিকে৷ সামান্য পথ৷ মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে যাই৷ এ জায়গাটিও নাম পেয়েছে স্থাপনাটির নামে৷ কিন্তু সামনে গিয়েই আবারো মন খারাপ হয়ে যায়৷ এটার অবস্থাও বড় কাটরার মতোই৷ দখলের ভারে যেন নুয়ে পড়েছে স্থাপনাটি৷ বড় কাটরা নির্মাণের প্রায় ২০ বছর পর সুবেদার শায়েস্তা খান বড় কাটরার পূর্ব পাশে নির্মাণ করেছিলেন এই ছোট কাটরা৷ অনেকটা বড় কাটরার আদলে তৈরি, তবে আকারে ছোট এ স্থাপনাটিও বাংলাদেশের জন্য একটি মূল্যবান প্রত্ন সম্পদ৷ আজ অবশ্য এ স্থাপনাও পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে৷ আর এটাও উদ্ধার করে সংস্কার করার বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি কখনোই৷
বড় কাটরার প্রায় দক্ষিণ বরাবর বুড়িগঙ্গা নদীর অপর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক স্থাপনা জিঞ্জিরা প্রাসাদ৷ কালের পরিবর্তনে এটাও দখল হয়ে গেছে৷ বহু বছর ধরে স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রাসাদ দখল করে রেখেছে৷ আগের তিনটি স্থাপনার অন্তত ছবি তুলতে পেরেছিলাম৷ কিন্তু জিঞ্জিরা প্রাসাদেরতো ছবিই তুলতে পারিনি৷ আমার হাতে ক্যামেরা দেখে এগিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন বখাটে যুবক৷ অনেকটা ধমকের সুরেই তারা বলে, ‘কী অইব এইসব ভাঙাচোরা দালানের ছবি তুইল্যা, ভাগেন তাড়াতাড়ি৷' ছবি না তুলেই শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে আমাকে পালাতে হয়েছিল৷
অথচ জিঞ্জিরা প্রাসাদের ইতিহাসও অনেক সমৃদ্ধ৷ জানা যায়, বাংলার মুঘল সুবেদার দ্বিতীয় ইব্রাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৭) তাঁর প্রমোদকেন্দ্র হিসেবে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন৷ এ প্রাসাদটি নিয়ে নানান কাহিনি প্রচলিত আছে লোকমুখে৷ নবাব সরফরাজ খানের (১৭৩৯-১৭৪০) পতনের পর তাঁর মাতা, স্ত্রী, বোন, পুত্র, কন্যাসহ হারেমের কিছু নারীকে নাকি এখানে বন্দি করা হয়৷ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর আলীবর্দী খানের প্রধান রানি শরীফুন্নেসা, সিরাজের মা আমেনা বেগম, খালা ঘসেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম ও কন্যা কুদসিয়া বেগম ওরফে উম্মে জোহরাকে জিঞ্জিরা প্রাসাদে এনে কড়া পাহারায় রাখা হয়৷ জনশ্রুতি আছে, নবাব মীর জাফর আলী খানের পুত্র মীর সাদেক আলী খান ওরফে মীরনের নির্দেশে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়ার অজুহাতে প্রাসাদ থেকে নৌকায় তুলে ধলেশ্বরী নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়৷
ঐতিহাসিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ এ সব স্থাপনা উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ কিন্তু ব্যর্থ কি আমরাও হইনি? এ তো আমাদেরই ইতিহাস, আমাদেরই ঐতিহ্য৷ এগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব কি আমাদেরও নয়? যারা এগুলো দখল করে রেখেছে, তাদের হাত থেকে ইতিহাসের এই স্মারকগুলোকে বাঁচানো কি আমাদেরও কর্তব্য নয়? আমরা কি সত্যিই পারি না এর জন্য জনমত গড়ে তুলতে?
পারি৷ আর তাই তো ক্যামেরাবন্দি করেছি এদের৷ এবার শুধু সরকারের সামনে আর্জি করার পালা৷ আপনারা আমার সঙ্গে আছেন তো? তা না হলে, স্থাপনাগুলো উদ্ধার করা না গেলে, অচিরেই যে এগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে৷
ঐতিহসিক এ সব স্থাপনা রক্ষায় আমাদের করণীয় কী হতে পারে, লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷