1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দলবদলের অসৎ, নীতিহীন রাজনীতির চারণভূমি পশ্চিমবঙ্গ

৮ অক্টোবর ২০২১

কয়েকমাস আগে যে নেতাকে মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতাচ্যূত করল, সেই এখন শাসকদলের অংশ। অসৎ রাজনীতির আরেক নাম এখন পশ্চিমবঙ্গ।

https://p.dw.com/p/41QZF
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: Mani Tewari Prabhakar

দোরগোড়ায় উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। কথা হচ্ছিল ওই রাজ্যের এক প্রবীণ রাজনীতিবিদের সঙ্গে। হাসতে হাসতে বলছিলেন, সরকারে যেই আসুক, শেষপর্যন্ত দেখা যায়, ৩০ শতাংশ বিধায়ক একই থেকে যান। কারণ, যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা সেই দলে ঢুকে পড়েন। এটাই উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির ছবি। নীতি-আদর্শের বালাই নেই। অর্থ এবং ক্ষমতাই আসল কথা।

উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানার এ হেন অসৎ ও নিম্নমানের রাজনীতি নিয়ে একসময় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রীতিমতো হাসাহাসি করতেন। গোটা দেশ এককথায় একটি কথা সে সময় স্বীকার করত, ভালো-মন্দ যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদেরা অন্তত অসৎ নন। অর্থের দিকে তাকিয়ে নয়, সেখানে রাজনীতি হয় আদর্শের দিকে তাকিয়ে।

ভাবতে লজ্জা হয়, গত কয়েকবছরে পশ্চিমবঙ্গের সেই আদর্শের রাজনীতি ধুলোয় গিয়ে মিশেছে। ক্ষমতা যেদিকে, নেতারাও সেদিকে ধেয়ে যাচ্ছেন, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে। নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই।

বৃহস্পতিবার সব্যসাচী দত্ত বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ঠিক এক বছর আগে এমনই এক পুজোর সময় তৃণমূল ছেড়ে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুণ্ডপাত করতে করতে। বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে লড়াইও করেছিলেন তিনি। যে কারণে বিজেপির দীর্ঘদিনের নেতা ওই সিটের টিকিট পাননি। আট হাজার ভোটে হেরেছিলেন সব্যসাচী।

মনে পড়ে, ডিডাব্লিউকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও কীভাবে সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন এই সাবেক বিধায়ক। প্রতিটি সভায় খুল্লামখুল্লা মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করতেন তিনি। প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু নির্বাচনে হেরেই সেই সবকিছু ভুলে গিয়ে শাসকদলের দরবারে পৌঁছে গেলেন। কোন আদর্শে? সম্ভবত, সব্যসাচী নিজেও জানেন না।

সব্যসাচী একা নন। সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন একদা বিজেপির মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার রদবদলের সময় তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বিজেপির প্রতি বাবুলের গোঁসা। দিনের পর দিন যে অভিষেককে তিনি তুলোধোনা করেছেন গণমাধ্যমে, জনসভায়, তার হাত ধরেই তিনি চলে এসেছেন শাসকদল তৃণমূলের আস্তানায়। শোনা যাচ্ছে, ভেট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদও পাবেন।

এক সময় তৃণমূলের দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন মুকুল রায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান শুরু হওয়ার পরে এবং নারদ-সারদা মামলায় তিনি জড়িয়ে যাওয়ার পরে পত্রপাঠ বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। বস্তুত, তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে নারদ-সারদা মামলা নিয়ে তাকে খুব বেগও পেতে হয়নি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তার বিরুদ্ধে তিরিশটিরও বেশি মামলা করেছিল বিভিন্ন বিষয়ে। একান্ত আড্ডায়, মুকুল একবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মমতা ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন। যা-ই ঘটে যাক, এই অপমান তিনি কখনো ভুলবেন না। ২০২১ সালের নির্বাচনে মুকুল বিজেপির টিকিটে জিতেছেন। কিন্তু দল ক্ষমতায় না আসায় তিনি ফের ফিরে গেছেন এতদিন যাদের নামে চক্রান্তের অভিযোগ করছিলেন, সেই তৃণমূলে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু বিধানসভায় এখনো বিজেপির বিধায়কের পদটি ছাড়েননি।

এমন আরো কয়েকডজন নেতা-নেত্রীর কথা লেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে যারা নীতি-আদর্শ বিকিয়ে শাসকদলে যোগ দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও দেবেন।

প্রশ্ন হলো, ব্যক্তিগত এবং সংকীর্ণ স্বার্থে যারা ক্ষমতাসীন দলের কাছে আসতে চাইছেন, ক্ষমতাসীন দল তাদের গ্রহণ করছে কেন? যে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে দুইদিন আগেও সাম্প্রদায়িকতা, কেলেঙ্কারি, আদর্শহীনতার মতো বড় বড় অভিযোগ করা হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তোলাবাজির অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তাদের কেন সাদর আমন্ত্রণে গ্রহণ করছে তৃণমূল?

এও এক আশ্চর্য সমাপতন। ক্ষমতাসীন দল আরো ক্ষমতা চায়। বিপক্ষকে সাইনবোর্ড বানানোর লক্ষ্যে তৃণমূল আজ নয়, বহুদিন আগে থেকেই এ খেলা শুরু করেছে। ২০১১ সাল পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস এবং সিপিএম-কেও ঠিক এভাবেই ভাঙাতে শুরু করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। কখনো টাকার লোভ, কখনো মামলার ভয় দেখিয়ে বিরোধী নেতাদের নিজের দলে নিয়ে এসে বিরোধীপক্ষের মাজা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একের পর এক বিরোধী বিধায়ককে দলে নেওয়া হয়েছে। অথচ বিধানসভায় তারা পদত্যাগ করেননি। এর ফলে তৃণমূলের সংকীর্ণ রাজনীতির লাভ হয়েছে না ক্ষতি, সে প্রশ্নের উত্তর ইতিহাস দেবে। কিন্তু সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে গন্ধ ডোবায় পরিণত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। যে পশ্চিমবঙ্গ কয়েকদশক আগেও হিন্দি বলয়ে রাজনীতি নিয়ে হাসাহাসি করত, এখন তাদের নিয়ে গোটা ভারত হাসাহাসি করে।

অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি যেমনই হোক, তার রাজনৈতিক ফোকাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। সিপিএম-এর বিরুদ্ধে তিনি পশ্চিমবঙ্গে লড়াই করছেন সেই আশির দশক থেকে। এখনো মনে আছে, ২০০১ সালে তার স্লোগান ছিল, 'হয় এবার, নয় নেভার'। ভয়াবহভাবে পর্যদস্তু হয়েছিলেন তিনি। চাইলে, তখন তো তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতেন তৎকালীন তৃণমূল নেতারা! যাননি। কারণ, একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে তারা লড়ছিলেন।

বামেদের কথাই ধরা যাক। ক্ষমতার সর্বোচ্চ সময়ে তারা বহু অন্যায় করেছেন নিশ্চয়। তবে আদর্শকে একেবারে বিকিয়ে দেননি। চাইলে তো তারাও পারতেন বিরোধী নেতাদের নিজেদের দলে নিয়ে আসতে। তারা সে কাজ করেননি কারণ, রাজনীতিতে কোথাও একটা আদর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিরোধী রাজনীতিকেও সম্মান জানানো হয়েছিল। টাকার সামনে এবং ক্ষমতার সামনে রাজনীতি পুরোপুরি বিক্রি হয়ে যায়নি।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবহ দেখলে হাসি পায় না, কান্না পায়। প্রশ্ন জাগে, কী লাভ ভোট দিয়ে? শেষপর্যন্ত তো সকলে একই গোয়ালে গিয়ে জুটবে?

ভোটের নামে এই প্রহসনের অর্থ কী!

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো