দাহ্য পদার্থের তথ্য গোপনে এত মৃত্যু
৫ জুন ২০২২শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে লাগা আগুন ২৪ ঘণ্টা পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি৷ ফায়ার সর্ভিসের ২৫টি ইউনিট ছাড়াও আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনা ২৫০ জন সেনা সদস্য কাজ করছেন৷ ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কেমিকেল আগুন নেভানোর বিশেষায়িত দল ‘হাজমত' টিম৷
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪৯ জন৷ তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ৯ জন৷ আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০০ জন৷ তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ আহত কয়েকজনকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা আনা হয়েছে৷ আরো আহতদের আনা হবে৷ হাসপাতালগুলোর পরিবেশ আহত এবং নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে৷
বিএম কনটেইনার ডিপোর অবস্থান চট্টগ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডে ২৪ একর জমির ওপর৷ সেখানে আগুনের সময় অন্তত ৬০০ জন কর্মী ছিলেন৷ কনটেইনার ছিলো চার হাজারের বেশি৷
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ( মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার জানান, ‘‘আগুন লাগার পর কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষকে আমরা পাইনি৷ তাদের কেউ আমাদের জানায়নি যে সেখানে কেমিকেল আছে৷ তথ্য জানা না থাকায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা যান৷ কারণ কেমিকেল থেকে লাগা আগুন নেভানোর কৌশল আলাদা৷ ভিন্ন ধরনের পার্সোনাল প্রটেকটিভ সরঞ্জাম লাগে৷ কেমিকেলের তথ্য না জানায় ফায়ার ফাইটার যারা ফ্রন্ট লাইনে ছিলেন তারা মারা যান৷
তিনি বলেন, ‘‘কনটেইনার ডিপো করতে হলে ফায়ার লাইসেন্স দরকার হয়৷ এটা ছাড়া ডিপো করা যায় না৷ আর কোনো দাহ্য পদার্থ বা কেমিকেল থাকলেও তা জানিয়ে রাখতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে৷ আমরা সেখানে অনেক কেমিকেলের উপস্থিতি পাচ্ছি৷ বিভিন্ন ধরনের কেমিকেলের অনেক ড্রাম রয়েছে সেখানে৷ তাদের ফায়ার লাইসেন্স আছে কী না আমরা তদন্ত করে দেখছি৷ তবে আমাদের তারা কেমিকেলের তথ্য জানায়নি এটা নিশ্চিত৷'' তিনি বলেন, ‘‘এখন আমরা ড্রোন ব্যবহার করে কেমিকেল চিহ্নিত করছি৷ ফোম ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি৷''
চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম জানিয়েছেন ওই ডিপোতে রপ্তানির জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিলো৷ এখান থেকে অনেক দিন ধরেই এটা রপ্তানি হচ্ছে৷ এটা তারা ডিক্লারেশন দিয়েই রপ্তানি করে৷ তবে এর বাইরে আর কোনো কেমিকেল এখানো রাখা ছিলো কী না তা তাদের জানানো হয়নি৷ তার কথা, ‘‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোনো দাহ্য পদার্থ বা বিস্ফোরক নয়৷ তবে যেকোনো জিনিসেই আগুন লাগতে পারে৷ কেউ আগুন লাগিয়ে দিতে পারে৷ আমি শুনেছি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড-এর পাফে স্টাপল ফাইবারের একটি কনটেইনার ছিলো৷ সেকারনেও আগুন ছড়াতে পারে৷ অটোমেটিক কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি৷ সেটা হলে জাহাজেও তো বিস্ফোরণ ঘটত৷''
এদিকে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আবদুল হান্নান জানান, ‘‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোনো বিস্ফোরক বা দাহ্য পদার্থ নয়৷ যে ৫৪টি দাহ্য পদার্থের তালিকা আছে তার মধ্যে এটা নেই৷ ফলে এটা আমদানি বা রপ্তানিতে আমাদের অনুমোদন লাগে না৷''
তবে তার কথা, ‘‘অন্য কোনো বিস্ফোরক বা কেমিকেল সেখানে থাকতে পারে৷ আগুন ও বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় তাই মনে হচ্ছে৷ সেটা তদন্ত করে দেখা দরকার৷''
স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম জানান, বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনার সংবাদ পেয়ে রাতেই সেখানে যান তিনি৷ গিয়ে দেখেন মালিক পক্ষের কেউ নাই৷ সবাই পালিয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘সেখানে আমি অনেক কনটেইনারে তরল কেমিকেল দেখেছি৷ বিস্ফোরণে কয়েক মাইল এলাকা কেঁপে উঠেছে৷ অনেক দূরে গিয়েও আঘাত করেছে বিস্ফোরিত কনটেইনারের বিভিন্ন অংশ৷'' তিনি জানান, ওখানে কেমিকেল, গার্মেন্টস পণ্য সব একসাথে ছিলো৷ দাহ্য পদার্থের আলাদা কোনো ব্যবস্থাপনা ছিলো না৷ অগ্নি নিরাপত্তা বলে কিছু ছিলো না বলে জানান তিনি৷
এদিকে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘‘ওই কনটেইনার ডিপোর কোনো কমপ্লায়েন্স নেই, এটা দুঃখজনক৷ আমরা ব্যবসায়ীরা যারা রপ্তানি করি তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি৷ বিজিএমইএ বলছে, ১০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক পুড়ে গেছে৷''
মালিকরা পালিয়ে গেলেও ডিপোর মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চিটাগং ডেনিম-এর জিএম মেজর(অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী ঘটনাস্থলে রয়েছেন৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিলো এটা নিশ্চিত৷ অন্য কোনো কেমিকেল ছিলো কী না তা বলতে পারছি না৷''
তিনি জানান, ‘‘ডিপোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কনটেইনার ছিলো৷ এর মধ্যে ৯০ ভাগই গার্মেন্টস পণ্য৷ কাজ করছিলো ৫৫০ জনের মত কর্মী৷''
মলিক পক্ষের লোকজন কেন পালিয়ে গেল এবং তাদের কেন পাওয়া যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তারা ভয় পেয়েছেন, তাই প্রকাশ্যে আসছেন না৷''
বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিক ও মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের এমডি মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ৷ তিনি গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান৷ তিনি একই সঙ্গে চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক৷ তিনি এবং মালিক পক্ষের অন্যরা এখন পলাতক৷ পত্রিকা, কনটেইনার ডিপো ও তৈরি পোশাক কারখানাসহ ১২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে তাদের৷