অভিযুক্তের ‘আত্মহত্যা’
১১ মার্চ ২০১৩অভিযুক্তের পরিবার বলছে, আত্মহত্যার দাবি অসত্য৷
বিডিআর বিদ্রোহের পর সেনা কর্মকর্তাদের নির্বিচারে হত্যাসহ নানা অভিযোগে বিচারাধীন অভিযুক্তদের ওপরও কারাবন্দি অবস্থায় নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন তাদের আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যরা৷ ‘রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু', ‘আত্মহত্যা'– কারো কারো মৃতদেহ উদ্ধারের পর মৃত্যুর কারণ হিসেবে এসব কথাই বলা হয়েছে৷ তখনও প্রতিবাদ এসেছে অভিযুক্তের পরিবার এবং আইনজীবীদের তরফ থেকে৷ গত ডিসেম্বরে রাতে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার সময় ভুল বাসে উঠে পড়েন এক তরুণী৷ বাসচালকসহ ৬ জন মিলে তাঁকে ধর্ষণ করে৷ ধর্ষণে বাধা দেয়ায় তরুণী এবং তাঁর সঙ্গীকে নির্মমভাবে পেটানো হয়৷ বাস থেকে ছুড়ে ফেলা হয় দুজনকেই৷ মারাত্মকভাবে আহত সেই ধর্ষিতা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শেষ পর্যন্ত মারাই যান গত ২৯ ডিসেম্বর৷
সোমবার সেই মামলার এক অভিযুক্ত রাম সিংয়ের ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেছে দিল্লির তিহার জেলে৷ তারপর থেকে যা যা চলছে তার সঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহের পরের ঘটনাবলি অনেকটাই মিলে যায়৷ ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরপিএন সিং জানিয়েছেন, রাম সিং আসলে আত্মঘাতীই হয়েছিলেন, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে তা খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত শুরু হয়েছে৷ তবে তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় না থেকেই প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছেন অনেকে৷ রাম সিংয়ের কথিত ‘আত্মহত্যা' নিয়ে সন্দেহের কথা উঠে আসছে৷ এমনকি ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যরাও স্পষ্ট ভাষায় জানাচ্ছেন তাঁদের অসন্তোষের কথা৷
তাঁদের অসন্তোষের কারণ, উপযুক্ত বিচার এবং শাস্তির আগেই অভিযুক্তের মৃত্যু, যা তাঁদের কারো কারো কাছেও কাম্য ছিলনা৷ অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন এবং গণধর্ষণের ধকল সইতে না পেরে মাত্র ২৩ বছর বয়সেই মারা যাওয়া সেই তরুণীর বাবা বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, রাম সিং মারা যাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে পুলিশ তাঁর নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ৷ ‘পুলিশ কী করে পারলো তাকে (রাম সিং) যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই মরতে দিতে? '– এই প্রশ্ন রেখে মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি, ‘‘এখন এ মামলা কোন দিকে গড়াবে সে কথাই ভাবছি৷''
ওদিকে রাম সিংয়ের বাবা মাঙ্গেলাল সিং জানিয়েছেন, তাঁর ছেলের আত্মহত্যার কথাই নয়, তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি ঠিক ছিলেন, বরং হাতে এমন ব্যথা ছিল যার কারণে নিজের কাপড় দিয়ে কেমন করে ঝুলে আত্মহত্যা করলেন সেটাই বিস্ময়কর৷ তাঁর দাবি, রাম সিংকে কারাগারে ধর্ষণসহ অনেকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, মৃত্যুর পেছনেও এমন কোনো নির্যাতন কাজ করে থাকতে পারে৷
বিস্ময়, অসন্তোষ, সন্দেহ এবং মামলার পরিণতি নিয়ে শঙ্কাই শেষ কথা নয়৷ আইনের যথার্থতা এবং কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে৷ আছে কারাগারেও আসামী কতটা নিরাপদ – এমন একটি প্রশ্ন৷ বাংলাদেশে এ প্রশ্ন উঠেছে আরো আগে৷ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর কারাগারেই হত্যা করা হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে৷ তাঁদের কারো বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগই ছিলনা৷ বাংলাদেশে তাই বন্দি অবস্থায় মৃত্যুর ইতিহাস আরো সুদীর্ঘ৷ বিডিআর বিদ্রোহ এবং দিল্লি ধর্ষণকাণ্ডের অভিযুক্তের মৃত্যু শুধু প্রশ্নই নতুন করে তুলে আনে৷ এক, সাধারণ মানুষের মতো অভিযুক্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়? রাষ্ট্র, প্রচলিত আইন এবং কারাপ্রশাসন তা নিশ্চিত করতে পারবে কবে?
নিরীহ, নির্দোষদেরই নিরাপত্তা যেখানে পদে পদে বিঘ্নিত, সেখানে এ প্রশ্নের সদুত্তরের অপেক্ষার সময় নাতিদীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম৷
এসিবি/এসবি (ডিপিএ, এপি, এএফপি)