প্রিয়ার (আসল নাম নয়) জন্ম আসামের শিলচরে ১৯৯১ সালে৷ জন্মসূত্রে সে নিঃসন্দেহে ভারতীয়৷ কিন্তু তার একটাই অপরাধ৷ প্রিয়ার বাবা-মা দুজনেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন ১৯৭১র কিছু পরে৷ ফলে, আইনের সংজ্ঞায় তারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী'৷
বর্তমানে প্রিয়া ভারতের একটি নামী সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করেন৷ তার গোটা জীবন কেটেছে ভারতীয়ত্বের চিহ্ন পর্যাপ্ত পরিমাণে গায়ে মেখে নিতে পারার চেষ্টায়৷ কখনো সেই চেষ্টায় বাধা হয়ে এসেছে পারিবারিকসূত্রে পাওয়া ‘সিলেটি কথার টান'৷ আবার অন্য সময় তার ভারতীয়ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আইনের বিভিন্ন মারপ্যাঁচ৷
প্রিয়ার বয়ানে, ‘‘গা থেকে বাংলাদেশি তকমা ঝেড়ে ফেলতে আমি আসাম ছেড়ে দক্ষিণ ভারতে চলে গেলাম৷ কিন্তু সেখানে আমার বন্ধুরাও আমায় সুযোগ পেলেই ‘এই বাংলাদেশি! এই বাঙাল!' বলে ডাকতে ভুলতো না৷ আমি আমার মাকে প্রশ্ন করতাম, কেন আমাকে বাকি বন্ধুদের মতো কলকাতার বাংলা শেখাওনি? আমার মায়ের উত্তর হত একটাই৷ আমরা তো কলকাতার বাঙালি নই৷ আমরা তো সিলেটি৷ কাগজে ভারতীয় নাগরিক৷ ফলে আমার গোটা জীবন কেটেছে ভারতীয়, বাঙালি, সিলেটি, বাংলাদেশি- এই সব তকমার সাথে অভ্যস্ত হতে হতে৷''
‘‘এ কথা সত্যি যে আমরা ১৯৭১ এর পরে এসেছি৷ কিন্তু আমাদের তো ফিরিয়ে দেয়নি এই ব্যবস্থা৷ আমি তো এখানেই জন্মেছি৷ আসাম-বাদে সারা ভারতে শিশুরা জন্মসূত্রে নাগরিক হয়৷ আমি তবে ভারতীয় নই কেন?'', প্রশ্ন তোলে প্রিয়া৷
স্বাভাবিকভাবেই, প্রিয়া বা তার পরিবারের নাম নবায়িত নাগরিকপঞ্জীতে ওঠার কথা নয়, কারণ তারা আসলেই ভারতে এসেছেন ১৯৭১-এর পর৷ কিন্তু তা হয়নি৷ গোটা পরিবার নিয়ে নাগরিকপঞ্জীতে সুখে অবস্থান করছেন তারা৷ কারণ? আসামে টাকা ফেললেই পাওয়া যায় রেশন কার্ড বা জমির দলিলের নকল কাগজ, যার সাহায্যে নাগরিকত্ব হয়ে ওঠে বাজারের পণ্য৷
কার ভারত? কে বিদেশি?
অন্যদিকে আছে শিলচরে জন্মানো আরেক তরুণ সুদীপ্ত৷ কলকাতায় সংগীতজগতে জমি খুঁজে পাওয়া সুদীপ্ত ‘দোহার' গানের দলের সদস্য৷ দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায় অবিভক্ত বাংলার গান শোনাতে৷ তার পরিবার শিলচরে বাস করছে আজ প্রায় দেড়শ' বছর ধরে৷ গান্ধীবাদী কর্মকাণ্ড থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন- সুদীপ্তর পূর্বপুরুষের নাম উঠে আসবে দক্ষিণ আসামের ইতিহাসের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পর্বে৷ অথচ, সুদীপ্তর নাম নাগরিকপঞ্জীর খসড়ায় খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
কলকাতা থেকে সুদীপ্ত জানালো, ‘‘কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর দুটো পংক্তি আসামের বাঙালিরা প্রায়ই আওড়ান: ‘যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সেই কেড়েছে ভয়, আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়৷' আসামে ভাষিক সত্ত্বা বাঁচানোর ক্ষেত্রে যতই আকাশজুড়ে আত্মপরিচয় লেখার কথা আমরা এখন বলি না কেন, আমার আত্মপরিচয় যে কী, সেটা নিয়েই এখনও নিশ্চিত হতে পারলাম না৷ আমার বাবা-মায়ের পরিবার মিলিয়ে কম করে দেড়শ' বছর ধরে আমরা এই অঞ্চলের বাসিন্দা৷ কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে আমিও সন্দেহজনক ব্যক্তি৷''
তবে সুদীপ্তও জানে, আত্মপরিচয়ের প্রমাণপত্র সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিতদের জন্য সহজলভ্য৷ সে বলে, ‘‘আমি জানি শিলচরে এমন কিছু চক্র কাজ করছে যারা গরীব মানুষদের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছে৷ তারা বলেছে যে টাকা দিলে কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকবে৷ আমি নাম না করেই বলছি যে এমন অনেক বিশিষ্টজন রয়েছেন যারা নিজেরা ১৯৭১ সালের পর এখানে এসেছেন৷ কিন্তু আর্থিক বা সামাজিক ক্ষমতা থাকায় তারা বেঁচে যাচ্ছে৷ সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন গরীব, সামর্থ্যহীন মানুষ৷''
যে কারণে ভারতের সরকারি পরিসংখ্যান এখনও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সংখ্যা বিষয়ে সংশয়ে ভোগে, তার পেছনে রয়েছে কাগজ কিনে নাগরিক হতে পারার সংস্কৃতি৷ যে ব্যবস্থায় আত্মপরিচয় সহজেই বদলে ফেলা যায় পকেটের জোরে, সেখানে ‘আসল ভারতীয়' থেকে ‘নকল ভারতীয়' আলাদা করবে কীভাবে ভারত রাষ্ট্র? আর ভাষিক পরিচয়? তা তো কোনোকালেই রাষ্ট্রের সীমানায় আবদ্ধ থাকেনি দক্ষিণ এশিয়ায়৷
সে কারণেই, নাগরিকপঞ্জীর নবায়ন শুধুই একটি লোক দেখানো অভিনয়, কারণ তার সাথে জোট বেঁধে এসেছে নাগরিকত্ব বিল, যা আইনে পরিণত হলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অমুসলিমরা ভারতে বৈধ বাসিন্দায় পরিণত হতে পারেন৷
ফলে প্রশ্ন উঠবেই, ভারতীয় নাগরিকত্ব আসলে কার জন্য বিলাসিতা আর কার জন্য প্রয়োজন? আর ভারতের সর্বধর্ম সমন্বয়ের যে চিত্র এতদিন ধরে প্রচলিত, সেই চিত্র কি বদলাচ্ছে না নাগরিকত্ব আইন বা নতুন নাগরিকপঞ্জী?
প্রিয়া ও সুদীপ্তর মধ্যে কে আসল ভারতীয়? আর যে ভারতীয়ের কাগজ নেই, যার সম্বল শুধুই ইতিহাস, তার ভাগ্যে কী আছে?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷