দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পরিবেশ বান্ধব ভবন
২৩ ডিসেম্বর ২০১১সঠিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাসের অনেকটাই যে বাঁচানো সম্ভব তার প্রমাণ দিল তাইওয়ানের মত একটি দেশ, যে কিনা সম্পদের ব্যাপারে সাশ্রয়ী মনোভাব না দেখিয়ে বরং দশকের পর দশক বিবেচনাহীন প্রবৃদ্ধির উপরই জোর দিয়েছে৷ সেখানেই যা ছিল একসময় বিশ্বের উচ্চতম ভবন, তা আজ হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পরিবেশবান্ধব ভবন৷
এই আকাশছোঁয়া বহুতল ভবনের পোশাকি নাম ‘তাইপে ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান'৷ দেখতে অনেকটা বাঁশ-এর মত৷ উচ্চতা ৫০০ মিটারেরও বেশি৷ তাইওয়ানে ট্যুরিস্টদের এই ভবন ঘুরে দেখতেই হয়৷ আগের সেই গরিমা সে হারিয়েছে৷ প্রায় দু'বছর হতে চলল নিজেকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম ভবন' বলার অধিকার তার নেই৷ তাইপের কাছ থেকে সে-সম্মান কেড়ে নিয়েছে দুবাই৷ ভবন পরিচালনা সংস্থার ভাইসপ্রেসিডেন্ট ক্যাথি ইয়াং অবশ্য আগে থেকেই নতুন কিছু খুঁজছিলেন - এমন কিছু যা ‘তাইপে ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান'এর প্রতীকী অবস্থানটাকে ধরে রাখতে পারবে৷
ক্যাথি বলছেন, ‘‘মানুষ আমাদের দেখে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে৷ তাই আমরা সবকিছু ভাল আর নিখুঁতভাবে করতে চাই৷ যাতে আমাদের কর্মীরা অন্য কোন বিল্ডিং-এর জন্য কাজ না করে বরং আমাদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে৷ আমি মনে করি, ‘তাইপে ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান'-এর জন্য কাজ করাটা গর্বেরই ব্যাপার৷ এতো তাইওয়ানেরই একটা প্রতীক৷''
২০০৮ সালে নতুন এক পথে যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যানেজার ক্যাথি ইয়াং৷ জ্বালানির দাম তখন হুহু করে বেড়েই চলেছে৷ ক্যাথি জানতে পারলেন যে, জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পদ সাশ্রয়ী ব্যবস্থার জন্য লিডস নামে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হয়ে থাকে৷ মালিকরা তাদের ভবনে স্বেচ্ছায় এধরনের ব্যবস্থা বসাতে পারে, নির্দিষ্ট পরিবেশবান্ধব মাত্রা মান্য করতে পারে এবং এভাবে পরিবেশ সুরক্ষার সার্টিফিকেট পেতে পারে৷ সার্টিফিকেটের মেয়াদ পাঁচ বছর৷ মেয়াদ ফুরোলে আবার নতুন করে পরীক্ষা করে দেখা হবে ভবনের সবকিছু পরিবেশ অনুকূল কিনা৷
ম্যানেজার ক্যাথি ইয়াং বলছেন, ‘‘আমরা প্রমাণ দিতে পারি যে ‘তাইপে ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান' বিল্ডিংটা পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করছে৷ আমাদের কোম্পানি সামাজিক এক দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে৷ বিশ্বের এরকম এক উঁচু ভবন দুই বছর ধরে চেষ্টার পর এই-যে সবুজ আর টেকসই হয়েছে, তার প্রমাণ আমরা দিতে পেরেছি৷ এর ফলে অন্য ভবনের মালিকরাও একই ব্যবস্থা নিতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন৷''
সব রকমের মান রক্ষা করে সবুজ সার্টিফইকেট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় দুটি বছর৷ ১১ হাজার মানুষ কাজ করেন এই বিশাল ভবনে৷ পানি আর বিদ্যুতের কম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়৷ আবর্জনার পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে হয়৷ ঘরে বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা রাখতে হয়৷ আর এই কাজের সহায়ক হয় জার্মান কোম্পানি সিমেন্স-এর প্রযুক্তি আর কারিগরি জ্ঞান৷
গোটা ভবন জুড়েই এক লক্ষ বিশ হাজার বর্গমিটার কাচ৷ আর সেই কাচে এসে পড়ছে সূর্যের প্রখর আলো৷ এতে ঘর হয়ে যায় প্রচণ্ড গরম৷ ফলে এয়ারকন্ডিশনার ছাড়া গতি নেই৷ সারাক্ষণ চালিয়ে রাখার ফলে বিদ্যুতের খরচ সাঙ্ঘাতিক বেড়ে যায়৷ সিমেন্স কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা লাইটিং-এর জন্য নতুন ব্যবস্থা প্রয়োগ করেন, বসিয়ে দেন সেন্সর৷ এতে জ্বালানির খরচ কমে যায় প্রায় ২০ শতাংশ৷ বছরে ৭ লক্ষ ডলার বেঁচে যায়৷ জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা নিতে ২০ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করতে হয়৷
ক্যাথি ইয়াং-এর কথায়, ‘‘আমার মনে হয়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যখন তাদের ভবিষ্যত দপ্তরের জন্য স্থান নির্বাচন করবে, তখন লিড সার্টিফিকেট বা অন্য কোন সবুজ সার্টিফিকেট একটা গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াবে৷ ফলে ভবনের মালিকরা সবুজ, পরিবেশবান্ধব পথে যাবেন কিনা তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার প্রণোদনা পাবেন৷''
তাইওয়ান সরকার জলহাওয়া রক্ষার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সত্যি কথা, কিন্তু এখনও অনেক কিছু করা বাকি৷ তাইওয়ান বিশ্বের বৃহত্তম সোলার সেল উৎপাদক দেশগুলোর একটি হলেও ‘তাইপে ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান' ভবন থেকে শহরের বাড়িঘরের ছাদে কোন সোলার মোডিউল চোখে পড়বেনা৷ একটিমাত্র ভবন নয়, জ্বালানির সাশ্রয় ঘটাতে হবে সর্বক্ষেত্রে - পরিবেশ রক্ষার চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে সবার মধ্যে৷
প্রতিবেদন: ক্লাউস বার্ডেনহাগেন/আব্দুল্লাহ আল-ফারূক
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ